বিশ্বজুড়ে টিকার ওপর আস্থা কমে গেছে। গত ১০০ বছরে রোগ প্রতিষেধক টিকার কারণে কোটি কোটি মানুষের জীবনরক্ষা করা সম্ভব হলেও অনেক দেশেই টিকার ক্ষেত্রে অনীহা তৈরি হয়েছে। এ প্রবণতা দিন দিন বাড়ছেই।
এ প্রবণতা সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। তারা একে ২০১৯ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্যের জন্য ১০টি চরম হুমকির তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে। বিশ্বের ১৪০টি দেশের এক লাখ ৪০ হাজার মানুষের ওপর গবেষণা করে এ তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে।
বিশ্বের বিভিন্ন স্থানের বেশির ভাগ নিম্ন আয়ের লোকজনই মনে করে যে টিকা গ্রহণ নিরাপদ। এর মধ্যে শীর্ষে রয়েছে দক্ষিণ এশিয়া। সেখানে প্রায় ৯৫ শতাংশ মানুষের টিকার ওপর আস্থা রয়েছে। অন্যদিকে এ তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে পূর্ব আফ্রিকা। সেখানকার ৯২ ভাগ মানুষের আস্থা রয়েছে টিকার ওপর।
বিশ্বজুড়ে টিকার ওপর অনীহা বাড়লেও যেসব দেশ টিকার ওপর আস্থা রেখেছে তার মধ্যে শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ এবং রুয়ান্ডা। অনেক প্রতিকূলতা থাকার পরও টিকা গ্রহণে নিরাপত্তা এবং কার্যকারিতা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছে। এ দুই দেশে টিকা গ্রহণের হারও সর্বোচ্চ।
বিশ্বের সবচেয়ে নিম্ন আয়ের দেশ হয়েও রুয়ান্ডা অল্প বয়সী নারীদের এইচপিভি টিকা নিশ্চিত করেছে। এ টিকার মাধ্যমে সার্ভিকাল ক্যান্সার প্রতিরোধ করা সম্ভব।
রোগ প্রতিষেধক টিকা বা ইনজেকশনের মাধ্যমে রোগকে দুর্বল করা হয় বা মৃত ব্যাকটেরিয়া রোগীর দেহে ঢোকানো হয়। টিকা তৈরি হওয়ার আগে বিশ্ব ছিল অনেক বেশি বিপজ্জনক। টিকা আবিষ্কারের আগে সহজেই আরোগ্য করা যায় এমন সব রোগে লাখ লাখ মানুষ মারা যেত।
টিকার ধারণা তৈরি হয়েছে চীনে। দশম শতাব্দীতে ‘ভ্যারিওলেশন’ নামক একটি চীনা চিকিৎসা পদ্ধতি ছিল যেখানে অসুস্থ রোগীর দেহ থেকে টিস্যু নিয়ে সেটা সুস্থ মানুষের দেহে বসিয়ে দেয়া হতো।
এর আট শতাব্দী পরে ব্রিটিশ ডা. এডওয়ার্ড জেনার লক্ষ্য করলেন দুধ দোয়ায় এমন ব্যক্তিরা গরুর যে বসন্ত রোগ হয় তাতে আক্রান্ত হলেও তাদের মধ্যে প্রাণঘাতী গুটি বসন্তের সংক্রমণ একেবারেই বিরল।
সে সময় গুটি বসন্ত ছিল সবচেয়ে ভয়ানক এক সংক্রামক ব্যাধি। এ রোগ যাদের হতো তাদের মধ্যে শতকরা ৩০ ভাগ মারা যেত। যারা বেঁচে থাকতেন তারা হয় অন্ধ হয়ে যেতেন কিংবা তাদের মুখে থাকতো মারাত্মক ক্ষতচিহ্ন।
১৭৯৬ সালে জেমস ফিপস নামে আট বছর বয়সী এক ছেলের ওপর এক পরীক্ষা চালান ড. জেনার। তিনি গরুর বসন্ত থেকে পুঁজ সংগ্রহ করে সেটা ইনজেকশন দিয়ে ওই ছেলের শরীরে ঢুকিয়ে দেন। কিছুদিন পর জেমস ফিপসের দেহে গরুর বসন্তের লক্ষণ ফুটে ওঠে।
ওই রোগ ভালো হওয়ার পর তিনি ছেলেটির দেহে গুটিবসন্তের জীবাণু ঢুকিয়ে দেন। কিন্তু দেখা গেল জেমস ফিপসের গুটিবসন্ত হলো না। গরুর বসন্তের জীবাণু তাকে আরও মারাত্মক গুটিবসন্ত থেকে রক্ষা করেছে।
ড. জেনারের এই পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয় ১৭৯৮ সালে। বিশ্ব এই প্রথম ভ্যাকসিন শব্দটার সাথে পরিচিত হলো। ‘ভ্যাকসিন’ শব্দটি এসেছে লাতিন শব্দ ‘ভ্যাক্সা’ থেকে যার অর্থ গরু।
গত এক শতাব্দীতে টিকা ব্যবহারের ফলে প্রাণহানির সংখ্যা অনেক কমেছে। ১৯৬০য়ের দশক থেকে হামের টিকা ব্যবহার শুরু হয়। কিন্তু তার আগে এই রোগে প্রতি বছর ২৬ লাখ লোক প্রাণ হারাতো।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেব অনুযায়ী, ২০০০ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত হামের টিকা ব্যবহারে মৃত্যুর সংখ্যা ৮০ শতাংশ কমে আসে। কয়েক দশক আগেও লাখ লাখ মানুষ পোলিওতে আক্রান্ত হয়ে পঙ্গুত্ব কিংবা মৃত্যু বরণ করতেন। এখন পোলিও প্রায় নির্মূল হয়ে গেছে। টিকা আবিষ্কারের সময় থেকেই চিকিৎসার নতুন এই পথ নিয়ে সন্দেহ ছিল।
আগে মানুষ ধর্মীয় কারণে টিকার ব্যাপারে সন্দিহান ছিলেন। তারা মনে করতেন টিকার মাধ্যমে দেহ অপবিত্র হয়। এটা মানুষের সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার খর্ব করে বলেও কিছু মানুষ মনে করতেন।
সপ্তদশ শতাব্দীতে ব্রিটেনের বিভিন্ন জায়গা জুড়ে টিকাবিরোধী লিগ গড়ে ওঠে। তারা বিকল্প ব্যবস্থার পরামর্শ দিতেন, যেমন রোগীকে আলাদা করে চিকিৎসা দেয়া।
ব্রিটিশ টিকাবিরোধী ব্যক্তিত্ব উইলিয়াম টেব যুক্তরাষ্ট্র সফর করার পর সেখানেও এই ধরনের সংগঠন গড়ে ওঠে।বর্তমানে টিকা-বিরোধী ব্যক্তিত্বদের একজন হলেন অ্যান্ড্রু ওয়েকফিল্ড। তিনি ১৯৯৮ সালে এক রিপোর্ট প্রকাশ করেন যেখানে তিনি একটি ভুল তথ্য উপস্থাপন করেন। এতে তিনি দাবি করেন, এমএমআর ভ্যাকসিনের সাথে অটিজম এবং পেটের অসুখের যোগাযোগ রয়েছে।
এমএমআর হচ্ছে একের ভেতর তিন টিকা। এটা শিশুদের ওপর ব্যবহার করা হয় হাম, মাম্পস, এবং রুবেলা প্রতিরোধের জন্য। পরে তার ওই গবেষণা ভুয়া বলে প্রতিপন্ন হয় এবং তার মেডিকেল ডিগ্রি কেড়ে নেয়া হয়।
কিন্তু তার ওই দাবির পর টিকা নেয়া শিশুর সংখ্যা কমে আসে। শুধুমাত্র ব্রিটেনেই ২০০৪ সালে এক লাখ শিশু কম টিকা নেয়। এর ফলে সে দেশে হামের প্রকোপ বেড়ে যায়। টিকাদানের ইস্যুটিকে ঘিরে রাজনীতিও বাড়ছে। ইতালির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ম্যাত্তেও সালভিনি বলেছেন তিনি টিকা-বিরোধীদের দলে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও কোন সাক্ষ্য-প্রমাণ ছাড়াই বলার চেষ্টা করেছিলেন যে, টিকার সাথে অটিজমের সম্পর্ক রয়েছে। তবে সম্প্রতি তিনি সব শিশুকে টিকা দেয়ার তাগিদ দিয়েছেন।
যদি জনসংখ্যার একটা বড় অংশ টিকা নেন তাহলে রোগের বিস্তার প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়। এর ফলে যাদের মধ্যে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম তারাও রোগের কবল থেকে রক্ষা পান। একে বলা হয় ‘গোষ্ঠীবদ্ধ প্রতিরোধ’। কিন্তু এই ধরনের প্রতিরোধ ব্যবস্থায় কোন পরিবর্তন ঘটলে সেটা বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়।
গোষ্ঠীবদ্ধ প্রতিরোধের জন্য কত লোককে টিকা দিতে হবে তা নির্ভর করে রোগের ওপর। যেমন, হামের ক্ষেত্রে জনগোষ্ঠীর ৯৫ শতাংশ লোককেই টিকা দিতে হয়। কিন্তু কম সংক্রামক ব্যাধি পোলিওর জন্য ৮০ শতাংশের বেশি হলেই চলে।
গত বছর নিউইয়র্কের ব্রুকলিনে অতি-কট্টর ইহুদি মহল্লায় কিছু লিফলেট বিতরণ করে বলা হয়েছিল টিকার সাথে অটিজমের সম্পর্ক রয়েছে। এরপর যুক্তরাষ্ট্রে কয়েক দশকের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় হামের প্রাদুর্ভাবের জন্য ঐ গোষ্ঠীকেই দায়ী করা হয়েছিল।
গত বছর ইংল্যান্ডের সবচেয়ে অভিজ্ঞ ডাক্তার হুঁশিয়ারি করেছিলেন এই বলে যে, সাধারণ মানুষ যেন স্যোশাল মিডিয়ায় টিকার ওপর ভুয়া খবর পড়ে প্রতারিত না হন।
মার্কিন গবেষকরা দেখিয়েছেন, রাশিয়ায় তৈরি কম্পিউটার প্রোগ্রাম ব্যবহার করে অনলাইনে টিকার ওপর মিথ্যা তথ্য প্রচার করা হচ্ছে যা সমাজে অস্থিরতা সৃষ্টি করছে। সারা বিশ্বে ৮৫ শতাংশ শিশুকে টিকা দেয়ার হার গত কয়েক বছর ধরে অপরিবর্তিতই রয়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, টিকার কারণে প্রতি বছর বিশ্বে ২০ থেকে ৩০ লাখ শিশুর প্রাণরক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে। যেসব দেশে যুদ্ধবিগ্রহ চলেছে বা যেখানে স্বাস্থ্য সেবা ব্যবস্থা খুবই দুর্বল সেখানে টিকা দেয়ার চ্যালেঞ্জ সবচেয়ে বেশি। এসব দেশের মধ্যে রয়েছে আফগানিস্তান, অ্যাঙ্গোলা এবং গণতান্ত্রিক কঙ্গো প্রজাতন্ত্র।
তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, উন্নত দেশগুলোতেও এই বিষয়ে অনীহা এসেছে। কারণ এসব রোগ যে কত ভয়াবহ হতে পারে সেটা তারা ভুলেই গেছে।