সরকারি নার্সিং ইনস্টিটিউটে পাস না করেও ১৭ শিক্ষার্থী ভর্তি!

রোগীদের চিকিৎসাসেবায় অন্তঃপ্রাণ ‘লেডি উইথ দ্য ল্যাম্প’ খ্যাত ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলের কল্যাণে সারাবিশ্বে নার্সিং একটি মহৎ পেশা হিসেবে গণ্য হয়ে থাকে। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে ছোট পরিসরে নার্সিং পরিদফতর হিসেবে এর যাত্রা শুরু। এ পেশার আধুনিকায়ন ও সেবার মান বৃদ্ধির লক্ষ্যে ২০১১ সালে নার্সিং পরিদফতরকে নার্সিং অ্যান্ড মিডওয়াইফারি অধিদফতরে রূপান্তর করা হয়। মহাপরিচালকসহ প্রয়োজনীয় জনবলের অনুমোদন দেয়া হয়।

নার্সদের মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নার্সদের তৃতীয় শ্রেণি থেকে দ্বিতীয় শ্রেণির পদমর্যাদা দেন। এত কিছুর পর কেমন চলছে নার্সিং সেক্টর। বিগত দু-তিন দশক ধরে নার্সিং পেশায় রয়েছেন এমন প্রবীণ নার্সরা হতাশা ব্যক্ত করে বলেন, ভালো নেই নার্সিং সেক্টরের লোকজন।

নার্সিং কলেজ ও ইনস্টিটিউটে ভর্তি পরীক্ষা, বদলি, পদায়ন, কেনাকাটা, প্রশিক্ষণ, পিআরএল, টাইম স্কেল, জিপিএফের টাকা উত্তোলন, মাতৃত্বকালীন ছুটি ও অর্জিত ছুটি- সর্বত্রই অনিয়ম ও দুর্নীতির শিকড় গেড়েছে। নার্সদের মধ্যে গ্রুপিং ও কোন্দলের কারণে নষ্ট হচ্ছে সম্প্রীতি। নার্সিং সেক্টরের অনিয়ম ও দুর্নীতিসহ সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে জাগো নিউজ’র বিশেষ সংবাদদাতা মনিরুজ্জামান উজ্জ্বলের অনুসন্ধানী প্রতিবেদন।

নার্সিং অ্যান্ড মিডওয়াইফারি অধিদফতরে যেন দুর্নীতির মচ্ছব চলছে। অধিদফতরটির অধীনে পরিচালিত রাজধানীসহ সারাদেশের বিভিন্ন নার্সিং কলেজ ও ইনস্টিটিউটে ভর্তি পরীক্ষা, শিক্ষার্থী ভর্তি, চাকরিতে বদলি, পদায়ন, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র, কম্পিউটার, কম্পিউটার সামগ্রী ও স্টেশনারিসহ কেনাকাটা, প্রশিক্ষণ, পিআরএল, টাইম স্কেল, জিপিএফের টাকা উত্তোলন, মাতৃত্বকালীন ছুটি ও অর্জিত ছুটি নিয়ে খোদ অধিদফতরসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কতিপয় অসৎ কর্মকর্তার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদে গজিয়ে ওঠা একটি সংঘবদ্ধ চক্র শত শত অসহায় ও সাধারণ নার্সদের কাছ থেকে প্রতিদিন লাখ লাখ টাকা অবৈধভাবে হাতিয়ে নিচ্ছেন।

সম্প্রতি জাগো নিউজ’র এক অনুসন্ধানে দেশের বিভিন্ন নার্সিং ইনস্টিটিউটে কমপক্ষে ১৭ জন ভুয়া শিক্ষার্থীকে অবৈধ উপায়ে ভর্তির নজিরবিহীন দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া গেছে। ভুয়া ওই শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা উৎকোচ গ্রহণের মাধ্যমে এ অবৈধ ভর্তি বাণিজ্য সম্পন্ন হয়।

গত ডিসেম্বরে কেন্দ্রীয়ভাবে অনুষ্ঠিত ডিপ্লোমা ইন নার্সিং সায়েন্স অ্যান্ড মিডওয়াইফারি কোর্সে মেধাবী ও যোগ্যপ্রার্থীদের বঞ্চিত করে ভুয়া শিক্ষার্থীদের ভর্তি করা হয়। জাগো নিউজ’র অনুসন্ধানে শুধুমাত্র ভর্তিরই চাঞ্চল্যকর তথ্য নয়; বদলি, পদায়ন, ক্রয়, প্রশিক্ষণ, পিআরএল, টাইম স্কেল, জিপিএফের টাকা উত্তোলন, মাতৃত্বকালীন ছুটি ও অর্জিত ছুটি মঞ্জুর করতে গিয়ে প্রতিদিন শত শত নার্সকে নানা গঞ্জনার মুখাপেক্ষী হওয়ার করুণ চিত্র উঠে এসেছে।

nurse

অনুসন্ধানে জানা গেছে, যে ১৭ জন ভুয়া শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়েছে ভর্তি পরীক্ষার ফলাফলে তাদের নাম মেধা তালিকায় তো দূরের কথা, তাদের কেউ ভর্তি পরীক্ষায় পাস নম্বর পর্যন্ত পাননি। প্রকাশিত ফলাফলে মেধা কিংবা অপেক্ষমাণ তালিকায়ও তাদের নাম ছিল না। অথচ খোদ নার্সিং অ্যান্ড মিডওয়াইফারি অধিদফতরের মহাপরিচালক ও ভর্তি কমিটির সভাপতি তন্দ্রা শিকদারের স্বাক্ষর ও সুপারিশে তাদের ভর্তি করা হয়।

ওই ১৭ জনের মধ্যে দুজন নোয়াখালী, চারজন যশোর, তিনজন কুমিল্লা, একজন করে মুন্সিগঞ্জ, পিরোজপুর, কিশোরগঞ্জ, রাঙ্গামাটি, নওগাঁ, দিনাজপুর, মানিকগঞ্জ, পটুয়াখালী ও ঢাকা কমিউনিটি নার্সিং কলেজে ভর্তি করা হয়। ‘টাকা হলে বাঘের চোখ মেলে’- এমন প্রবাদের মতো অবৈধভাবে ভর্তি হওয়া এসব ‘গুণধর’ শিক্ষার্থী গত পাঁচ মাসেরও বেশি সময় ধরে ক্লাস করছেন।

স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের চিকিৎসা শিক্ষা ও নার্সিং বিভাগ, নার্সিং অধিদফতর ও নার্সিং কাউন্সিলের একাধিক দায়িত্বশীল কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপকালে জানা যায়, ভর্তিতে অনিয়মের এ ঘটনা শুধু ডিপ্লোমা কোর্সেই প্রথমবারের মতো ঘটেছে- এমনটি নয়। নিরপেক্ষ তদন্ত হলে বিভিন্ন সময় সরকারি নার্সিং কলেজ ও নার্সিং ইনস্টিটিউটের পোস্ট বেসিক বিএসসি নার্সিং, বেসিক বিএসসি নার্সিং ভর্তি পরীক্ষার ফলাফলে একাধিকবার এমন অনেক ঘটনার প্রমাণ মিলবে বলে তারা মন্তব্য করেন।

আক্ষেপ করে তারা আরও বলেন, ‘লেডি উইথ দ্য ল্যাম্প’ খ্যাত ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলের মহৎ পেশা অর্থাৎ নার্সিং শিক্ষায় এখন আতুর ঘরেই দুর্নীতির বীজ বপন করা হচ্ছে। এবার হাতেনাতে এর অকাট্য প্রমাণ মিলেছে।

উল্লেখ্য, গত বছরের ৭ ডিসেম্বর প্রথমবারের মতো নার্সিং অ্যান্ড মিডওয়াইফারি অধিদফতরের অধীনে কেন্দ্রীয়ভাবে ১০০ নম্বরের নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্নপত্রে বিএসসি ইন নার্সিং, ডিপ্লোমা ইন নার্সিং সায়েন্স অ্যান্ড মিডওয়াইফারি এবং ডিপ্লোমা ইন মিডওয়াইফারি কোর্সে এ ভর্তি পরীক্ষা হয়।

৪৩টি সরকারি ডিপ্লোমা ইন নার্সিং সায়েন্স অ্যান্ড মিডওয়াইফারি ইনস্টিটিউশনে দুই হাজার ৫৮০টি, ৩৮টি ডিপ্লোমা ইন মিডওয়াইফারি ইনস্টিটিউশনে ৯৭৫টি এবং চার বছর মেয়াদি ১৮টি সরকারি বিএসসি ইন নার্সিং কলেজে আসন সংখ্যা এক হাজার ৪৩৫টি। এসব আসনের বিপরীতে অর্ধলক্ষাধিক শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করেন।

ভর্তি নীতিমালা অনুসারে, ভর্তি পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বরের ভিত্তিতে জাতীয় মেধা তালিকা প্রণীত হয়। মেধা তালিকার পর অপেক্ষমাণ তালিকা থেকে শিক্ষার্থী ভর্তি করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু সংঘবদ্ধ চক্রের সদস্যরা নিয়ননীতি তোয়াক্কা না করে ১৭ জন ভুয়া শিক্ষার্থী ভর্তি করে।

যেভাবে ভর্তি হন ১৭ শিক্ষার্থী

জাগো নিউজ’র অনুসন্ধানে দেখা গেছে, নোয়াখালী নার্সিং ইনস্টিটিউটে ডিপ্লোমা ইন নার্সিং অ্যান্ড মিডওয়াইফারি কোর্সে (২০১৮-১৯ সেশন) ভর্তি হয়েছেন মোছা. মুনিয়া পারভীন। পিতা মো. আবদুল মান্নান। ভর্তি পরীক্ষায় (রোল নম্বর- ৩৩৪২৭১) তিনি পাস করেননি। পরীক্ষার প্রবেশপত্রে তার নাম মোছা. মুনিয়া পারভীন। ফলাফলে নাম আছে মোছা. তহুরা খাতুন।

একই প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়েছেন বেবি আক্তার, পিতা বাবুল হোসেন। রোল নম্বর- ৭৩৩২৬৮। তার পরীক্ষার প্রবেশপত্রের তথ্যের সঙ্গে ফরমের মিল নেই। প্রবেশপত্রে নাম বেবী আক্তার হলেও ফলাফলে নাম রয়েছে রেশমা আক্তার।

nurse

যশোর নার্সিং ইনস্টিটিউটে ভর্তি হয়েছেন মোছা. মনিরা খাতুন । পিতা মো. জয়নাল মোল্যা। রোল নম্বর- ৪৩২১৪৩। ভর্তি পরীক্ষায় তার প্রাপ্ত নম্বর ২৫। রেজাল্ট সিটে উল্লেখ নেই, অপেক্ষমাণ ফলাফলে উল্লেখ নেই এবং প্রজ্ঞাপনেও তার নাম উল্লেখ নেই কিন্তু ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন।

একই প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়েছেন আফসানা মিমি লিমা। পিতার নাম ছানোয়ার হোসেন। রোল নম্বর- ৪৩০১০৫। ভর্তি পরীক্ষায় তার প্রাপ্ত নম্বর ৩৮। রেজাল্ট সিটে উল্লেখ নেই, অপেক্ষমাণ ফলাফলে উল্লেখ নেই, এমনকি প্রজ্ঞাপনেও তার নাম উল্লেখ নেই কিন্তু তিনিও ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন।

তার মতো আরেকজন মোছা. ফাতেমা খাতুন। পিতার নাম মো. মনিরুজ্জামান। রোল নম্বর- ৪৩২৩০৫। প্রাপ্ত নম্বর ৪৯। ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হননি। রেজাল্ট সিট, অপেক্ষমাণ ফলাফল এবং প্রজ্ঞাপনেও উল্লেখ নেই কিন্তু অদৃশ্য হাতের ইশারায় তিনিও এখন নিয়মিত ছাত্র।

একই প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়েছেন শারমীন আক্তার। পিতা মুনসুর আলী। রোল নম্বর- ৪১০২১৮। তিনি ডিপ্লোমা ইন মিডওয়াইফারিতে পরীক্ষা দিয়ে পাস না করেও ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন।

কুমিল্লা নার্সিং ইনস্টিটিউটে ভর্তি হয়েছেন মো. লিমন মিয়া। পিতার নাম গোলাপ মিয়া। রোল নম্বর- ৭৩৪৫৭০। পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বর ৮০। রেজাল্ট সিট, অপেক্ষমাণ ফলাফল এবং প্রজ্ঞাপনে তার নাম উল্লেখ না থাকলেও তিনি ভর্তি হয়েছেন।

পরীক্ষার ফলাফলে নাম নেই কিন্তু অপেক্ষমাণ তালিকায় নাম আছে এমন যাদের বিভিন্ন ইনস্টিটিউটে অবৈধভাবে ভর্তি করা হয়েছে তাদের মধ্যে মুন্সিগঞ্জের রোকসানা আক্তার (রোল নম্বর- ৭১১২০০), পিরোজপুরের আঁখি বড়াল (রোল নম্বর- ১১১১০৭), কিশোরগঞ্জের মোছা. শ্রাবণী চৌধুরী (রোল নম্বর- ৭১০৮৫০), রাঙ্গামাটির দিপা রানী রায় (রোল নম্বর- ৭১০৬১৮), কুমিল্লার নাসরীন খাতুন (রোল নম্বর- ৩১০৯৫৭), নওগাঁর মোছা. আন্না আক্তার (রোল নম্বর- ৮১০২৬৮), দিনাজপুরের উন্মে আয়মন (রোল নম্বর- ৬১০২৩৬), মানিকগঞ্জের মিতু আক্তার (রোল নম্বর- ৮১০০৯৪) এবং পটুয়াখালীর সাহেদা আক্তার (রোল নম্বর- ৬১০৭২৩)।

এছাড়া ঢাকা কমিউনিটি নার্সিং কলেজে ভর্তি হয়েছেন মো. রিয়াদ হোসেন। রোল নম্বর- ১৩২২২৮। প্রবেশপত্রের সঙ্গে এই শিক্ষার্থীর রেজিস্ট্রেশন ফরমের ছবির কোনো মিল পাওয়া যায়নি।

নার্সিং কাউন্সিলের রেজিস্ট্রার যা বললেন

জাগো নিউজ’র হাতে থাকা ভর্তিতে অনিয়মের এসব তথ্য তুলে ধরা হয় নার্সিং কাউন্সিলের রেজিস্ট্রার সুরাইয়া বেগমের সামনে। তিনি অনিয়মের সত্যতা স্বীকার করে মন্তব্য করেন, ‘দেশের বিভিন্ন নার্সিং ইনস্টিটিউটে মোট ১৭ জন শিক্ষার্থীর ভর্তিতে অনিয়মের তথ্য আমরা পেয়েছি। এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় (চিকিৎসা অনুবিভাগ) ও নার্সিং অ্যান্ড মিডওয়াইফারি কাউন্সিলের মহাপরিচালককে অবহিত করা হয়েছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘প্রচলিত নিয়মে ভর্তি পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে অধিদফতর প্রণীত জাতীয় মেধা তালিকা অনুসরণ করে বিভিন্ন নার্সিং ইনস্টিটিউটে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়। ভর্তি প্রক্রিয়া শেষে শিক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশনের জন্য কাউন্সিলে আবেদন করতে হয়। আবেদনপত্রের সঙ্গে শিক্ষার্থীর নাম, পিতার নাম, ঠিকানা, শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ, মার্কশিট, পরীক্ষার রোল নম্বর, প্রবেশপত্র ও জাতীয় মেধা তালিকার ভিত্তিতে কোন প্রতিষ্ঠানে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন- এসব তথ্যও পাঠাতে হয়। অধিদফতর প্রেরিত নামের তালিকার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কলেজের ভর্তি তালিকা ও প্রয়োজনীয় তালিকা মিলিয়ে দেখে তবেই শিক্ষার্থীকে তারা রেজিস্ট্রেশন প্রদান করেন। গত ৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ মেধা তালিকার সঙ্গে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের কাগজপত্র পরীক্ষা করতে গিয়ে তারা ১৭ শিক্ষার্থীর ভর্তির বিষয়ে গড়মিল খুঁজে পান। তাদের অনেকে ভর্তি পরীক্ষায় ফেল করেছেন আবার অনেকের নাম তালিকায়ও ছিল না। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। তারাই সিদ্ধান্ত দেবেন।’

নার্সিং অধিদফতরের পরিচালক (শিক্ষা) যা বললেন

নার্সিং অধিদফতরের পরিচালক (শিক্ষা) জাহেরা খাতুনের সঙ্গে গতকাল মঙ্গলবার (১১ জুন) দুপুরে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, সরকারি নিয়ম অনুযায়ী এ সংক্রান্ত কোনো তথ্য তিনি দিতে পারবেন না। তথ্য জানতে হলে অধিদফতরের মহাপরিচালক বরাবর আবেদন করে তার অনুমোদন নিয়ে আসার পরামর্শ দেন।

পরিচালক (শিক্ষা) হিসেবে ভর্তিতে অনিয়মের বিষয়টি তার নজরে এসেছে কি না- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘জানলেও বলা যাবে না। ‘

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (চিকিৎসা অনুবিভাগ) যা বললেন

স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (চিকিৎসা অনুবিভাগ) ড. মুহাম্মদ আনোয়ার হোসেন এ প্রসঙ্গে বলেন, অনিয়মের অভিযোগ সম্পর্কে তিনি অবহিত। এ ব্যাপারে যুগ্ম সচিবের (নির্মাণ ও মেরামত অধিশাখা) নেতৃত্বে দুই সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। তারা তদন্ত করছেন। তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর অভিযোগ সত্য প্রমাণিত হলে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

আতুর ঘরেই (অধিদফতর) দুর্নীতি

স্বাধীনতার পর নার্সিং সেবা, প্রশাসন ও মানোন্নয়নে স্বতন্ত্র নার্সিং পরিদফতর প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের নার্সিং সেবার পেশাগত মানোন্নয়ন ও মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য তৃতীয় শ্রেণি থেকে দ্বিতীয় শ্রেণির পদমর্যাদায় উত্তীর্ণ করেন। ২০১১ সালে পরিদফতরকে নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদফতরে উন্নীত করেন। মহাপরিচালকসহ প্রয়োজনীয় জনবলের অনুমোদন দেন।

সরকারি ৩০ হাজার নার্সের সকল প্রকার প্রশাসনিক কার্যক্রম নার্সিং অ্যান্ড মিডওয়াইফারি অধিদফতরের মাধ্যমে পরিচালিত হলেও যে উদ্দেশ্য নিয়ে অধিদফতর গঠিত হয়েছিল কাঙ্ক্ষিত সে লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে অধিদফতর।

নার্সিং সেক্টরে দীর্ঘদিন কর্মরত এমন কয়েকজন সিনিয়র নার্স নাম প্রকাশ না করার শর্তে জাগো নিউজকে জানান, একসময়ের চিহ্নিত বিএনপি-জামায়াত ঘরানার নার্সনেতা, যারা বর্তমানে ভোল পাল্টে ক্ষমতাসীন দলের নাম ভাঙিয়ে অধিদফতর জিম্মি করে রেখেছেন। বদলি, পদায়ন, পদোন্নতি, দেশে-বিদেশে প্রশিক্ষণ, আসবাবপত্র কেনাকাটা ইত্যাদি সবকিছুই কথিত ওই নার্স নেতাদের পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত সিন্ডিকেটের সদস্যদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হয়।

সাধারণ নার্সরা জানান, তাদের ভোগান্তি কমাতে অনলাইনে বদলির আবেদনের নতুন নিয়ম চালু করেছে মন্ত্রণালয়। পারিবারিকসহ বদলির উপযুক্ত কারণ দেখিয়ে স্ব স্ব প্রতিষ্ঠানপ্রধানের ফরওয়ার্ডিং নিয়ে নার্সরা অধিদফতরে বদলির আবেদন জমা দেন।

ভুক্তভোগী এক নার্স জাগো নিউজ’র এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে হতাশা ব্যক্ত করে জানান, তার স্বামী রংপুরে থাকেন। তার পোস্টিং অন্য জেলায়। দু’জন দু’জায়গায় থাকায় স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করার হুমকি দেন। সংসার রক্ষায় নিজ জেলায় শূন্যপদ খুঁজে বের করে অধিদফতরে আবেদনপত্র জমা দেন। কিন্তু অধিদফতরে তা কয়েক মাস ফেলে রাখা হয়। পরে অধিদফতরে যোগাযোগ করে ধারকর্জ করে জনৈক কর্মকর্তাকে ঘুষ (স্পিড মানি) দিয়ে তবেই বদলির আদেশ পান।

বদলির ক্ষেত্রে স্পিড পানি সর্বনিম্ন এক লাখ টাকা থেকে দুই লাখ টাকা লাগে। অধিদফতরের মহাপরিচালককে আহ্বায়ক করে অধিদফতর ও মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে বদলি কমিটি থাকলেও মূলত বদলি বাণিজ্যের সঙ্গে একজন প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও একজন সহকারী পরিচালক জড়িত বলেও অভিযোগ করেন তিনি।

প্রশিক্ষণের সুযোগ পেতেও মোটা অঙ্কের ঘুষ লেনদেন

পেশাগত কাজের মানোন্নয়নে বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, নার্সিং কলেজ ও ইনস্টিটিউটের নার্সদের দেশ-বিদেশে প্রশিক্ষণের জন্য অধিদফতর থেকে মনোনয়ন ও অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয়। অভিযোগ রয়েছে, প্রশিক্ষণের জন্য উপযুক্ত প্রার্থী বাছাইয়ে স্ট্যান্ডার্ড কোনো নীতিমালা না থাকায় অধিদফতরে প্রশিক্ষণ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সুনজরে যারা থাকেন তারাই বারবার প্রশিক্ষণের জন্য মনোনয়ন পান। দেশ কিংবা বিদেশে প্রশিক্ষণের সুযোগ পেতেও মোটা অঙ্কের ঘুষ লেনদেন হয়।

প্রশিক্ষণের সময় অনেক ক্ষেত্রে নার্স ও শিক্ষকদের কম সম্মানি দেয়া হয়। একজন শিক্ষিকা জানান, রিসোর্স পার্সন হিসেবে তারা কোথাও গেলে দৈনিক তিন হাজার টাকা (ভ্যাট বাদ দিয়ে দুই হাজার ৭০০ টাকা) দেয়ার কথা। কিন্তু দেয়া হয় এক হাজার টাকা। টাকা গ্রহণের রসিদে টাকার ঘর ফাঁকা রেখে স্বাক্ষর করতে বলা হয়। অস্বীকৃতি জানালে প্রাপ্য দুই হাজার ৭০০ টাকা দেয়া হলেও পরবর্তীতে তাকে আর রিসোর্স পার্সন হিসেবে ডাকা হয় না।

আবার অনেক কর্মকর্তা প্রশিক্ষণে রিসোর্স পার্সন হিসেবে সশরীরে উপস্থিত না থেকেও প্রাপ্য সম্মানি ভাতা সংগ্রহ করেন।

জানা গেছে, বিদেশে দেড়-দুই মাসের প্রশিক্ষণ গ্রহণ কিংবা হজ মেডিকেল টিমের সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হলে একেকজন নার্স ৭-৮ লাখ টাকা বেতন-ভাতা পান। এজন্য তাকে সর্বনিম্ন দুই লাখ থেকে চার লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ দিয়ে হয়। হজ মেডিকেল টিমের সদস্য হতে হলে এমনটি বেশি ঘটে। গত বছর পর্যন্ত হজ মেডিকেল টিমে একই ব্যক্তি চার-পাঁচবার যাওয়ার সুযোগ পেয়েছেন। বিষয়টি স্বাস্থ্যমন্ত্রীর নজরে এলে এবারই প্রথম একাধিকবার হজ করেছেন এমন সদস্যদের বাদ দেয়া হয়।

পদায়নের ক্ষেত্রেও অবৈধ আর্থিক লেনদেন

পদায়নের ক্ষেত্রেও অবৈধ আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ রয়েছে। সম্প্রতি বগুড়ায় জনৈক অপেক্ষাকৃত নবীন এক নার্সকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ দেয়া নিয়ে সেখানকার নার্সরা বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। ওই প্রতিষ্ঠানে থাইল্যান্ড থেকে নার্সিংয়ে মাস্টার্স করা একজন সিনিয়র নার্সকে নিয়োগ না দেয়ায় সাধারণ নার্সদের মধ্যে ক্ষোভ দেখা দেয়। অভিযোগ রয়েছে, অধিদফতরের জনৈক এক কর্মকর্তাকে ছয় লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে এ পদায়ন দেয়া হয়।

নার্সিং অধিদফতরের আওতাধীন বিভিন্ন নার্সিং কলেজ ও ইনস্টিটিউটে অর্থ বরাদ্দ দেয়ার ক্ষেত্রেও বড় ধরনের বৈষম্য পরিলক্ষিত হয়। কথিত রয়েছে, শতকরা ১০ ভাগ আগাম কমিশনের চুক্তিতে প্রতিষ্ঠানভেদে কম-বেশি অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয়। এছাড়া আসবাবপত্র, স্টেশনারি ও অন্যান্য মালপত্র টেন্ডার-কোটেশন ছাড়াই অনেক সময় ক্রয় করা হয়।

অনিয়ম নিয়ে কথা বলায় দুই নার্সকে কারণ দর্শাও নোটিশ

সম্প্রতি বেসরকারি ৭১ টেলিভিশনের টকশোতে অংশগ্রহণ করে উপস্থাপিকার প্রশ্নের জবাবে নার্সিং সেক্টরে বিদ্যমান নানা সমস্যা নিয়ে কথা বলেন দুই সিনিয়র নার্স। এ অপরাধে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে নার্সিং অধিদফতর থেকে বাংলাদেশ নার্সেস অ্যাসোসিয়েশনের (বিএনএ) ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ইসমত আরা এবং স্বাধীনতা নার্সেস পরিষদের মহাসচিব ইকবাল হোসেন সবুজকে কারণ দর্শাতে চিঠি দেয় অধিদফতর।

নোটিশে উল্লেখ করা হয়, টকশোতে তারা অসত্য ও বিভ্রান্তকর তথ্য উপস্থাপন করেছেন, যা সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছে। বিষয়টি স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের গত ২৭ মে স্মারকে অত্র অধিদফতরকে অবহিতকরণপূর্বক তাদের বিরুদ্ধে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়। একই সঙ্গে ‘এখন থেকে অধিদফতরের বিনা অনুমতিতে কোনো টিভি বা রেডিও অনুষ্ঠানে কথা বলা যাবে না’ বলে জানায় অধিদফতর।

ওই ঘটনায় ক্ষুব্ধ হন সাধারণ নার্সরা। তারা জানান, সত্য কথা বলার অপরাধে ওই দুই নার্স নেতার বিরুদ্ধে শোকজ জারি করা হয়েছে। ভবিষ্যতে যেন কোনো অনিয়মের ব্যাপারে কেউ মুখ না খোলে সেজন্য হয়রানি করতেই এ শোকজ।

অনিয়ম ও দুর্নীতিতে শোনা যাচ্ছে যাদের নাম

নার্সিং অধিদফতরে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে ঘুরেফিরে অনেকেরই নাম আসছে। তাদের মধ্যে প্রশাসনিক কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন, সহকারী পরিচালক শিরীন আক্তার, হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা আবদুল হান্নান, নার্সিং অফিসার খোরশেদ আলম ও কোর্স সমন্বয়ক খায়রুল হকের নাম উল্লেখযোগ্য। এছাড়া সাইদুর রহমান, মোক্তার হোসেন, আবদুল লতিফ, ওলিউল্ল্যাহ, আতিয়ার, রেজাউল, শওকত, আবদুল মমিন, খলিল, তাজুল ইসলাম, আবদুল হাই, মহসিন ও কিবরিয়ার নাম জানা গেছে ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে।

জানা গেছে, রাজধানীর মিরপুর ও কল্যাণপুরে একাধিক বহুতল ভবন ও ফ্ল্যাট রয়েছে হিসাবরক্ষক আবদুল হান্নানের। তার দুই ছেলে-মেয়ে রাজধানীর বেসরকারি মেডিকেল কলেজে পড়াশোনা করছেন। তার বিরুদ্ধে নিজ স্ত্রীকে হত্যার অভিযোগ রয়েছে। এ কারণে তিন মাস জেলও খাটেন তিনি। জেলে থাকলেও এ হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তাকে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়নি।

অধিদফতরের কো-অর্ডিনেটর (প্রশিক্ষণ ও শৃংখলা) হিসেবে কর্মরত খাইরুল কবির। গত ১৯ বছর ধরে একই প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। পোস্টিং ঢাকার বাইরে হলেও ডেপুটেশনে তিনি অধিদফতরেই থেকে যাচ্ছেন। বছরখানেক আগে তাকে প্রোগ্রাম ম্যানেজারের (চলতি দায়িত্ব) দায়িত্ব দেয়া হয়। সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী বিষয়টি জানতে পেরে তাকে ওই পদ থেকে অব্যাহতি দেন। অব্যাহতি প্রদানের পরও তাকে প্রোগ্রাম ম্যানেজার দেখিয়ে নার্সিং মহাপরিচালক তন্দ্রা শিকদার কয়েক মাস আগে তাকে লন্ডন সফর করান। এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে অবহিত করা হয়নি বলেও অভিযোগ আছে।

এছাড়া অধিদফতরের যত কর্মকর্তা ও নার্স বিদেশে প্রশিক্ষণে যান তাদের বিমানের টিকিট সংগ্রহের কাজটি করেন খাইরুল কবির। টিকিটের কমিশন বাবদ লাখ লাখ টাকা তার পকেটে যায় বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে।

শৃঙ্খলা শাখার কো-অর্ডিনেটর হিসেবে কর্মরত খায়রুল ও হাফিজুর রহমান (ক্লার্ক)। নার্সদের বিরুদ্ধে আসা বিভিন্ন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তাদের কঠোর শাস্তি প্রদান করা হবে- এমন ভয় দেখিয়ে মোটা অঙ্কের উৎকোচ গ্রহণ করেন বলে অভিযোগ সাধারণ নার্সদের। উৎকোচ না দিলে দোষী না হয়েও নার্সদের বিরুদ্ধে নানা শাস্তিমূলক ব্যবস্থার সুপারিশ করে মহাপরিচালককে দিয়ে তা বাস্তবায়ন করেন বলেও ভুক্তভোগীদের অভিযোগ।

বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ ওঠা প্রশাসনিক কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে গতকাল মঙ্গলবার কথা হয় জাগো নিউজ’র। তিনি তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ মিথ্যা, মনগড়া ও বানোয়াট বলে মন্তব্য করেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, নার্সিং অধিদফতরের অনেক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নানা দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সেগুলোর অনুসন্ধানে নেমেছে। দুদকের এক কর্মকর্তা জানান, কয়েক মাস আগে অধিদফতরের আওতাধীন রাজধানীর মুগদার একটি প্রতিষ্ঠানে অভিযানকালে শিক্ষার্থীদের ভর্তিতে ২৯ লাখ টাকা অতিরিক্ত আদায়ের প্রমাণ তারা পেয়েছেন।

নার্সিং ইনস্টিটিউটে ভুয়া শিক্ষার্থী ভর্তি এবং বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগের বিষয়ে জানতে গতকাল মঙ্গলবার (১১ জুন) নার্সিং অ্যান্ড মিডওয়াইফারি অধিদফতরের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত) সচিব তন্দ্রা শিকদারের মোবাইল নম্বরে কয়েক দফা যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তিনি মোবাইল ফোন রিসিভ করেননি। তার ঘনিষ্ঠজনরা জানান, উনি হাতেগোনা কয়েকজন ছাড়া কারও ফোন রিসিভ করেন না। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিরুদ্ধে তদন্ত কমিটি গঠিত হলেও তিনি সেসবের পরোয়া করেন না। কারণ তদন্ত কমিটির প্রধান তার জুনিয়র এক যুগ্ম সচিব।

সূত্রঃ জাগোনিউজ২৪

About Post Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *