স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে বিধি লঙ্ঘন করে বেশ কয়েকজন কর্মকর্তাকে পদায়ন করা হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভার সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করে এ পদায়ন হয়েছে। সম্প্রতি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় পদায়নের আদেশ জারি করে। সংশ্নিষ্টরা বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে একনেকের সভায় যে সিদ্ধান্ত হয়, তা কোনো মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর কিংবা পরিদপ্তর পরিবর্তন করার ক্ষমতা রাখে না। সমকালের এ-সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাবে স্বাস্থ্যমন্ত্রী, স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কোনো মন্তব্য করেননি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য আবুল কালাম আজাদ বলেন, প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে একনেক সভায় যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, তা পরিবর্তন করার সুযোগ কোনো মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর কিংবা পরিদপ্তরের নেই। কোনো সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে হলে একনেকে অনুমোদন নিতে হবে।
যেভাবে সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন : বর্তমানে স্বাস্থ্য খাতে পাঁচ বছর মেয়াদি চতুর্থ স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি সেক্টর কর্মসূচি (চতুর্থ এইচপিএনএসপি) চলছে। ২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসে এই কর্মসূচি শুরু হয়েছে। শেষ হবে ২০২২ সালের জুন মাসে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে এই কর্মসূচির ৩২টি অপারেশনাল প্ল্যান (ওপি) রয়েছে। সরকার, বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী ও দাতাগোষ্ঠীর সহায়তায় এটি বাস্তবায়ন করা হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে একনেক সভায় চতুর্থ এইচপিএনএসপি অনুমোদন করা হয়েছে। ওই সভায় ৩২টি ওপি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও এর আওতাধীন স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর, ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর, নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তর, নিপোর্টের কোন কোন কর্মকর্তা কিংবা শাখাপ্রধান বাস্তবায়ন করবেন, সে সম্পর্কে সিদ্ধান্ত হয়। সম্প্রতি সেই সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে পরিচালক ও লাইন ডিরেক্টর পদে কর্মকর্তাদের পদায়ন করা হয়েছে। কমিউনিটি ক্লিনিক দিবস পালন উপলক্ষে সম্প্রতি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সমকালের এ-সংক্রান্ত প্রশ্নে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক, স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব আসাদুল ইসলাম এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ নিশ্চুপ ছিলেন। অথচ স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকও একনেকের সদস্য।
যাদের পদায়ন করা হলো :এমএনসিএএন্ডএইচের লাইন ডিরেক্টর ডা. সুলতান মো. শামসুজ্জামানকে চলতি দায়িত্বে জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠানের (আইপিএইচএন) পরিচালক করা হয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত অপারেশনাল প্ল্যান (ওপি)-ন্যাশনাল নিউট্রিশন সার্ভিসেস (এনএনএস) কর্মসূচির লাইন ডিরেক্টর করা হয়েছে ডা. এস এম মোস্তাফিজুর রহমানকে। তিনি একই কর্মসূচির প্রোগ্রাম ম্যানেজার ছিলেন। একনেক সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, আইপিএইচএনের যিনি পরিচালক থাকবেন, তিনিই এর সঙ্গে যুক্ত ওপি এনএনএসের লাইন ডিরেক্টর হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। কিন্তু এই কর্মসূচিকে পৃথক করে একজনকে পরিচালক এবং সমমর্যাদার অন্য এক কর্মকর্তাকে লাইন ডিরেক্টর করা হয়েছে। একইভাবে স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটে সংযুক্ত উপপরিচালক ডা. মো. আমিনুল হাসানকে পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলো) করা হয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত ওপি হসপিটাল সার্ভিসেস ম্যানেজমেন্টের লাইন ডিরেক্টর হিসেবে মেডিকেল এডুকেশন অ্যান্ড এইচএমপিডির উপপরিচালক ডা. সত্যকাম চক্রবর্তীকে পদায়ন করা হয়েছে। বগুড়া জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. কে এম আহসান হাবিবকে প্রথমে পরিচালক (চিকিৎসা শিক্ষা ও জনশক্তি উন্নয়ন) এবং স্বাস্থ্য ও জনশক্তি উন্নয়ন শাখার লাইন ডিরেক্টর করা হয়। কিন্তু পরে তাকে শুধু পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে এবং লাইন ডিরেক্টরের দায়িত্ব দেওয়া হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের ইএনটি বিভাগের অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলামকে। স্বাস্থ্যশিক্ষা ব্যুরোপ্রধান ও হেলথ এডুকেশন অ্যান্ড প্রমোশন অ্যান্ড লাইফ স্টাইল প্রোগ্রামের লাইন ডিরেক্টর মো. আবদুল আজিজকে শুধু স্বাস্থ্যশিক্ষা ব্যুরোর প্রধান হিসেবে রাখা হয়েছে। লাইন ডিরেক্টরের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে ঢাকার সিভিল সার্জন ডা. এহসানুল করিমকে।
পরিকল্পনা ও গবেষণা (পিএমআর) শাখার পরিচালক এবং পিএমআর লাইন ডিরেক্টর ডা. মেহের পারভীনকে শুধু পিএমআরের লাইন ডিরেক্টরের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। উপপরিচালক (হাসপাতাল-২) ডা. শরীফুল হক সিদ্দিকীকে চলতি দায়িত্বে পরিচালক (গবেষণা ও উন্নয়ন) করা হয়েছে।
ডা. রওশন আনোয়ারকে পিএইচসির পরিচালক করা হয়েছে এবং এর সঙ্গে যুক্ত ওপি এমএনসিএন্ডএইচের লাইন ডিরেক্টর করা হয়েছে ডা. মো. শামসুল হককে। উপপরিচালক (হোমিও ও দেশজ) এবং প্রোগ্রাম ম্যানেজ ডা. এফ বি এম আবদুল লতিফকে একই শাখার পরিচালক এবং ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স অ্যান্ড হাসপাতালের উপপরিচালক ডা. মো. হাবিবুর রহমানকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে ওএসডি করে এর সঙ্গে যুক্ত ওপি এএমসির লাইন ডিরেক্টর করা হয়েছে।
এক কর্মসূচিতে দু’জন পরিচালক :স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমের (এমআইএস) পরিচালক ডা. সমীর কান্তি সরকার। এর সঙ্গে যুক্ত ওপি হেলথ ইনফরমেশন সিস্টেম অ্যান্ড ই-হেলথ (এইচআইএস অ্যান্ড ই-হেলথ) কর্মসূচির লাইন ডিরেক্টরও তিনি। এর পরও ডা. আবদুস সালাম নামের এক পরিচালককে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে ওএসডি করে এমআইএস প্রোগ্রামে সংযুক্ত করে রাখা হয়েছে। এর আগে ডা. আবদুল গনি নামের আরেক পরিচালককে আইইডিসিআরে ওএসডি সংযুক্তি করা হয়। আইইডিসিআরের পরিচালক হিসেবে আছেন অধ্যাপক ডা. মীরজাদি সেব্রিনা। তবে কয়েক দিন আগে ডা. গনিকে ঢাকার বাইরে একটি হাসপাতালে পরিচালক হিসেবে পদায়ন করা হয়।
পদায়ন করা কর্মকর্তারাও পরস্পরবিরোধী অবস্থানে :স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পাঁচজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কাজেকর্মে গতিশীলতার কথা বলে প্রতিটি শাখায় একজন পরিচালক এবং একজন করে লাইন ডিরেক্টর করা হয়েছে। কিন্তু গতিশীলতা তো দূরের কথা, পদায়ন করা কর্মকর্তারা শুরুতেই দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছেন। তাদের বেশিরভাগ কর্মকর্তার জন্য এখনও অফিসকক্ষের ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়নি। সম্প্রতি এক যুগ্ম সচিবের কক্ষে সমকালের সঙ্গে একটি প্রোগ্রামের একজন লাইন ডিরেক্টরের কথা হয়। তিনি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে পদায়নের আগে একটি জেলার সিভিল সার্জন ছিলেন। ওই কর্মকর্তা জানান, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তুলনায় সিভিল সার্জন হিসেবে তিনি ভালো ছিলেন। বড় পদে পদায়ন করা হলেও তিনি কক্ষ বরাদ্দ পাননি। একটি সভায় স্বাস্থ্যমন্ত্রী এবং মহাপরিচালককে বিষয়টি অবহিত করে তিনি আগের পদে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন।
পরিচালক এবং লাইন ডিরেক্টররাও পরস্পরের মধ্যে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছেন। একজন পরিচালক জানান, তিনি যে শাখার পরিচালক হিসেবে পদায়ন পেয়েছেন, সেখানে লাইন ডিরেক্টর তাকে কাজ করতে দিচ্ছেন না। এমনকি লাইন ডিরেক্টর নিজেকে পরিচালকের তুলনায় বড় কর্মকর্তা মনে করেন। এতে লাইন ডিরেক্টর এবং পরিচালকদের মধ্যে দ্বন্দ্ব বিরাজ করছে। একজন লাইন ডিরেক্টর জানান, লাইন ডিরেক্টরের কাজ ও দায়িত্ব পরিচালকের তুলনায় অনেক বেশি। কিন্তু পরিচালকরা নিজেদের স্থায়ী পদে কর্মকর্তা মনে করেন। এ কারণে তারা লাইন ডিরেক্টরদের সহ্য করতে পারেন না।
চিকিৎসকদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) মহাসচিব ডা. ইহতেশামুল হক চৌধুরী দুলাল বলেন, এ ধরনের দ্বন্দ্বের খবর তার কাছেও এসেছে। পদায়ন করা অনেক কর্মকর্তার রাজনৈতিক পরিচয় সরকারবিরোধী। ছাত্রজীবনে বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন এমন অনেককে উচ্চ পদে পদায়ন করা হয়েছে। সরকারের উন্নয়নমূলক কাজ তারা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করবেন, তা আশা করা যায় না। সরকারি কর্মসূচির জন্য বরাদ্দ অর্থ তারা ব্যয় করেননি। এ কারণে সে অর্থ ফেরত চলে গেছে। এর মধ্য দিয়ে বিষয়টি প্রমাণ হয়েছে।
স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) সভাপতি অধ্যাপক ডা. এম ইকবাল আর্সলান বলেন, দ্বৈত প্রশাসন কোনো প্রশাসনই না। একটি কর্মসূচিতে দু’জন সমমর্যাদার কর্মকর্তারা কী করে যুক্ত করা হয়? তাদের কাজের ধরন কেমন হবে? এসব নিয়ে জটিলতা আছে। এমন হলে কর্মকর্তারা দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়বেন এবং কাজকর্মে বিঘ্ন সৃষ্টি হবে, তা স্বাভাবিক। এতে সরকারের উন্নয়নকাজ বাধাগ্রস্ত হবে।