দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে বাড়ছে খাদ্যচাহিদাও। ক্রমবর্ধমান খাদ্যচাহিদার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে কৃষি উৎপাদনও। এ কারণে দেশের মানুষের খাদ্যনিরাপত্তার চ্যালেঞ্জ অনেকটাই মোকাবেলা করা সম্ভব হয়েছে। তবে চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়ে গেছে পুষ্টিচাহিদা পূরণ করা। চাহিদা পূরণে ধান-চালের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে এনে বিকল্প খাদ্যপণ্য ব্যবহারের ওপর সরকারের পক্ষ থেকে উৎসাহ দেয়া হচ্ছে। এক্ষেত্রে অন্যতম বিকল্প খাবার হতে পারে মিষ্টি আলু। মানুষের শর্করার চাহিদা পূরণে মিষ্টি আলু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম।
মিষ্টি আলু মূলত কন্দালজাতীয় ফসল। এটি উষ্ণমণ্ডলীয় অঞ্চলের দেশগুলোয় সবচেয়ে বেশি জন্মায়। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) এক প্রতিবেদেনে বলা হয়েছে, বর্তমানে বিশ্বের ১১৭টির বেশি দেশে মিষ্টি আলু আবাদ করা হয়। প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী উৎপাদন হয় ১১ কোটি ২০ লাখ টনের বেশি মিষ্টি আলু। মধ্য আমেরিকায় উত্পত্তি হলেও বর্তমানে মিষ্টি আলুর সর্বোচ্চ উৎপাদনকারী দেশ চীন। পাপুয়া নিউগিনিসহ অনেক দেশ আছে, যেখানে মিষ্টি আলু প্রধান খাদ্য হিসেবে বিবেচিত হয়।
মূলত পর্তুগিজ বণিকদের হাত ধরে ভারতবর্ষে আসে মিষ্টি আলু। ক্রমেই কৃষিপ্রধান বাংলায় জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ফসলটি। বর্তমানে দেশের প্রতিটি জেলাতেই মিষ্টি আলু আবাদ হয়। পাওয়া যায় সর্বত্রই। রয়েছে বহুমুখী ব্যবহার। আর এ সহজপ্রাপ্যতা ও বহুমুখী ব্যবহার কাজে লাগিয়ে মিষ্টি আলু দিয়ে মানুষের পুষ্টিচাহিদা পূরণের বিষয়টি সামনে এসেছে।
মিষ্টি আলু একদিকে পুষ্টিগুণসম্পন্ন একটি ফসল। আবাদে খরচও হয় অনেক কম। তাই কৃষক ও ভোক্তা সবার কাছেই মিষ্টি আলু একটি লাভজনক ফসল হিসেবে বিবেচিত হয়। প্রচলিত উপায়ে মিষ্টি আলু রান্না করে খাওয়ার পাশাপাশি এর ভক্ষণযোগ্য মূল সেদ্ধ করে খাওয়া যায়। বিভিন্ন ধরনের প্রক্রিয়াজাত খাবার (চিপস, আটা, ময়দা, ইত্যাদি) তৈরিতে মিষ্টি আলু ব্যবহার করা যায়। এছাড়া কনফেকশনারি দ্রব্যাদি তৈরি, এমনকি অ্যালকোহল শিল্পে এটি ব্যবহার করা হয়। মিষ্টি আলু গাছের পাতা সবজি হিসেবে ব্যবহার হয়। এটি থেকে উত্কৃষ্ট গোখাদ্য তৈরি করা সম্ভব। এসব কারণে মিষ্টি আলু দিয়ে বিশাল জনগোষ্ঠীর পুষ্টিচাহিদা সহজেই পূরণ করা সম্ভব। বিশেষত রঙিন শাঁসযুক্ত মিষ্টি আলু খাদ্য ও পুষ্টিনিরাপত্তায় একটি সম্ভাবনাময় ফসল।
বর্তমানে দেশের প্রায় সব জেলাতেই কম-বেশি মিষ্টি আলু আবাদ হয়। রয়েছে স্থানীয় অসংখ্য জাত। তবে এসব জাত খুব একটা উন্নত নয়। ফলনও হয় তুলনামূলক কম। স্থানীয় জাতগুলো থেকে প্রতি হেক্টর জমিতে ১০ টনের কম মিষ্টি আলু উৎপাদন হয়। এ কারণে মানুষের পুষ্টিচাহিদা পূরণে মিষ্টি আলুর ফলন বাড়ানোর ওপর জোর দিয়েছে সরকার। নতুন নতুন উচ্চফলনশীল মিষ্টি আলুর জাত উদ্ভাবন করেছে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট। এসব উচ্চফলনশীল জাত ব্যবহার করে প্রতি হেক্টর জমি থেকে ৩০-৪৫ টন মিষ্টি আলু উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে। দেশব্যাপী ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে এসব জাত।
পুষ্টিচাহিদা ও অর্থনৈতিক লাভ বিবেচনায় কৃষকদের মধ্যে মিষ্টি আলু চাষ জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করেছে। ফলে দেশে ফসলটির আবাদ ও উৎপাদন দুটোই বাড়তির দিকে রয়েছে। বর্তমানে দেশে ২৬ হাজার হেক্টরের বেশি কৃষিজমিতে মিষ্টি আলু আবাদ হচ্ছে। ফসলটির বার্ষিক উৎপাদন ১০ লাখ টন ছাড়িয়ে গেছে। এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের উদ্ভাবন করা উচ্চফলনশীল জাতগুলো।
দেশে মিষ্টি আলুর আবাদ ও উৎপাদন বাড়াতে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের আওতাধীন কন্দাল ফসল গবেষণা কেন্দ্র। প্রতিষ্ঠানটি ১৯৯৮ সালে মিষ্টি আলুর উচ্চফলনশীল জাত বারি-২ বাজারে আনে। কৃষকদের কাছে জাতটি কমলাসুন্দরী নামে পরিচিত। এ জাত ব্যবহার করে প্রতি হেক্টর জমি থেকে ৪০-৪৫ টন মিষ্টি আলু উৎপাদন করা যায়। এছাড়া রয়েছে বারি-৪, বারি-৮, বারি-১১, বারি-১২, বারি-১৪, বারি-১৬সহ মিষ্টি আলুর বেশ কয়েকটি উচ্চফলনশীল জাত। এসব জাত ব্যবহার করে ১২০-১৪০ দিনের মধ্যেই প্রতি হেক্টর জমি থেকে সর্বোচ্চ ৪৫ টন মিষ্টি আলু উৎপাদন করা যায়।
বসতবাড়ির আশপাশের জমিতে সহজেই মিষ্টি আলু আবাদ করা যায়। এতে খরচও হয় কম। কৃষি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে প্রতি হেক্টর জমিতে মিষ্টি আলু আবাদ করতে প্রায় ২ লাখ টাকা খরচ হয়। আয় হয় প্রায় ৬ লাখ টাকা। মূলত প্রতি বছর অক্টোবর-নভেম্বরে মিষ্টি আলুর লতা রোপণ করা হয়। ফেব্রুয়ারি-মার্চ নাগাদ কন্দ সংগ্রহ করা হয়। এর মধ্যে মিষ্টি আলু গাছের পাতা শাক হিসেবে অনেকে খেয়ে থাকে। কন্দ বা আলুর পাশাপাশি শাক বিক্রি করেও বাড়তি আয় করা সম্ভব। পুষ্টিগুণ বিবেচনায় ও তুলনামূলক কম উৎপাদন ব্যয়ে লাভ বেশি হওয়ায় কৃষকরাও এটি আবাদে আগ্রহী হয়ে উঠবেন। এছাড়া দেশের লবণাক্ত ও খরাপ্রবণ এলাকাগুলোতেও সহজেই মিষ্টি আলু আবাদ করা যায়।
জাতীয় পুষ্টিনিরাপত্তায় ভূমিকা রাখার স্বার্থে দেশে মিষ্টি আলুর চাষাবাদ ও ব্যবহার ব্যাপকভাবে সম্প্রসারণ করা প্রয়োজন। এজন্য মিষ্টি আলুর পুষ্টি গুণাগুণ সম্পর্কে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে প্রচারণা চালানো জরুরি। এছাড়া মানুষের প্রচলিত খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন, খাদ্যের বহুবিধ ব্যবহার, উচ্চফলনশীল জাতগুলো দেশব্যাপী জনপ্রিয় করা, সহজে বীজের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা, দ্রুত বাজারজাত প্রক্রিয়া ও প্রক্রিয়াকরণ সুবিধা ছড়িয়ে দেয়া, সংরক্ষণ সুবিধা বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ নিতে হবে। আমাদের দেশে মিষ্টি আলুকে আরো বেশি জনপ্রিয় করতে গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হতে পারে প্রক্রিয়াজাত শিল্পে এর ব্যবহার বাড়ানো। উত্তোলনের পর মিষ্টি আলু স্বাভাবিক তাপমাত্রায় মাত্র এক-দেড় মাস সংরক্ষণ করা যায়। ফলে মিষ্টি আলুর প্রাপ্যতা সারা বছর নিশ্চিত করতে হলে প্রক্রিয়াজাত খাদ্য হিসেবে এর ব্যবহার বাড়ানো জরুরি। চীন, জাপান, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম ছাড়াও আফ্রিকা মহাদেশের কিছু দেশে প্রক্রিয়াজাত খাদ্য হিসেবে মিষ্টি আলু সারা বছর পাওয়া যায়। রান্নার পরও রঙিন শাঁসযুক্ত মিষ্টি আলুতে ৭০ শতাংশের বেশি বিটাক্যারোটিন অবশিষ্ট থাকে। ফলে প্রক্রিয়াজাত খাবার হিসেবে বছরজুড়ে ভিটামিন ‘এ’র চাহিদা পূরণে মিষ্টি আলু ভূমিকা রাখতে পারে।
বহুবিধ ব্যবহারের মাধ্যমে বাংলাদেশের পুষ্টিনিরাপত্তায় (বিশেষত ভিটামিন ‘এ’র চাহিদা পূরণে) মিষ্টি আলুর গুরুত্ব রয়েছে। ফসলটিকে দেশব্যাপী জনপ্রিয় করতে মিষ্টি আলুর পুষ্টিগুণ ও ব্যবহার সম্পর্কে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানো প্রয়োজন। পাশাপাশি বছরব্যাপী প্রাপ্যতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে দীর্ঘসময় সংরক্ষণের প্রয়োজনীয় উদ্যোগ ও প্রক্রিয়াজাত শিল্পে মিষ্টি আলুর ব্যবহার বৃদ্ধির উদ্যোগ নেয়া জরুরি হয়ে পড়েছে। এজন্য সরকারের পাশাপাশি স্বাস্থ্য, গ্রামীণ ও সামাজিক উন্নয়ন এবং কৃষি উৎপাদন সম্পর্কিত বেসরকারি সংস্থাগুলোকেও এগিয়ে আসতে হবে। সরকারি-বেসরকারি সমন্বিত উদ্যোগ মানুষের পুষ্টিচাহিদা পূরণে জাতীয় পর্যায়ে মিষ্টি আলুকে আরো জনপ্রিয় করে তুলতে সক্ষম হবে।
মিষ্টি আলুর পুষ্টিগুণ ও উপকারিতা
মিষ্টি আলুতে প্রচুর পরিমাণে শর্করা, খনিজ, ভিটামিন-এ, ভিটামিন-বি, ভিটামিন-সি ও ভিটামিন-ই রয়েছে। বিশেষ করে কমলা ও বেগুনি শাঁসযুক্ত মিষ্টি আলুতে বিটাক্যারোটিন ও অ্যান্থোসায়ানিন রয়েছে। রাতকানা রোগ প্রতিরোধে মিষ্টি আলু খুবই কার্যকর। বিশেষত কমলা শাঁসযুক্ত মিষ্টি আলু খেয়ে সহজেই ভিটামিন ‘এ’র চাহিদা পূরণ করা যায়।
গবেষণায় দেখা গেছে, রঙিন শাঁসযুক্ত মিষ্টি আলু প্রতিদিন ১২৫ গ্রাম করে খেলে পাঁচ-ছয় বছরের একটি শিশুর ভিটামিন ‘এ’র চাহিদা পূরণ করা যায়। আর পূর্ণবয়স্ক মানুষের ভিটামিন ‘এ’র প্রাত্যহিক চাহিদা পূরণে ১৫০-২০০ গ্রামের একটি মিষ্টি আলু যথেষ্ট। ফসলটির গ্লাইসেমিক ইনডেক্স অন্যান্য ফসলের তুলনায় কম হওয়ায় ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তিরা শর্করার চাহিদা পূরণে মিষ্টি আলু খেতে পারেন। এছাড়া মিষ্টি আলুতে বিদ্যমান বিটাক্যারোটিন ও অ্যান্থোসায়ানিন নামের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও অ্যান্টিকারসিনোজেনিক উপাদান বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সার নিরাময়ে কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে। মিষ্টি আলুর ভিটামিন বি-৬ রক্তনালিকে স্বাভাবিক রেখে হূদরোগ নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে।