রমজান মাসে রোজার সময় সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সবরকমের পানাহার থেকে মুক্ত থাকতে হয়। সাথে সাথে সবধরনের অশ্লিল, খারাপ কাজ ও কথাবার্তা থেকে বিরত থাকাটাও রমজানের রোজার শিক্ষার অন্তর্ভূক্ত।
এবারের রোজা পড়েছে গ্রীষ্মকালে এবং দীর্ঘকালীন সময় ধরে প্রায় ১৪-১৫ ঘণ্টা পানাহার না করে থাকতে হবে। তাই খাবার দাবারের ব্যাপারে একটু বেশি সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। কারণ খেয়াল রাখতে হবে অসুস্থ হয়ে পড়লে এবাদত করতে কষ্ট হবে। রোজার মাসে খাবার দাবারের ব্যাপারে বিশেষ কোন বিধি নিষেধ আরোপ করা হয়নি। খাদ্যের ব্যাপারে কোরআন হাদিসে যে সব সাধারণ বিধি নিষেধ আরোপ করা আছে এখানেও সেটাই প্রযোজ্য। একজন মানুষ যে ধরনের খাবারে অভ্যস্ত সে ধরনের খাবারও এখানে খাবেন। তবে যেহেতু রমজান সংযমের মাস এবং খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকার মাস, সেহেতু যেসব খাদ্য শরীরের জন্য ক্ষতিকর এধরনের খাদ্য না খাওয়ার প্র্যাকটিস এই মাসেই শুরু করা উচিত। সুষম খাদ্য খাওয়ার অভ্যাস এ মাসেই করা উচিত। এটা রমযান মাসের জন্যও ভাল এবং পরবর্তী মাসগুলোতে সুস্থ থাকার জন্যও ভাল।
রমজানে কি ধরনের খাবার খাওয়া উচিতঃ
১.টাটকা শাক-সবজি- যার মধ্যে থাকে প্রচুর পরিমাণ আঁশ, ভিটামিন এবং খনিজ পদার্থ। শিম জাতীয় খাদ্য যেমন- সীম, মটরশুটি, ডাল প্রভৃতি। বাদাম সব সময়ের জন্যই উপকারী।
২.তাজা ফল ও ফলের রস।
৩.আমিষের জন্য মাছ, মাংস, কম চর্বি যুক্ত দুধ ও দুগ্ধ জাতীয় খাদ্য। মাছ, মাংস বেশি ভাজি করে না খাওয়া ভাল। ফ্রাই করার চেয়ে বেকিং বা গ্রীল করে খাওয়া ভাল। ডিম প্রতিদিন একটি করে খাওয়া যেতে পারে।
৪.শষ্যদানার মধ্যে উত্তম হল লাল আটার রুটি, লাল চালের ভাত এবং আলু।
যেসব খাদ্য পরিহার করা উচিতঃ
ভাজাপোড়া খাদ্য সেটা মাংস হোক আর অন্য কিছু হোক রোজা রেখে না খাওয়া ভালো। কলিজা, মগজ, মুরগীর চামড়া খাদ্য তালিকা থেকে বাদ থাকবে। অতিরিক্ত চর্বি যুক্ত যেকোন খাদ্য এ সময়ে চলবে না। আইসক্রীম, পেস্ট্রি, বেশি বেশি মিষ্টি খাওয়া চলবে না। নারকেলে ক্ষতিকর চর্বি জাতীয় তেল বেশি থাকে বলে না খাওয়া ভাল।
রমজানে দীর্ঘ উপবাসের পর ইফতার দিয়ে খাওয়া শুরু হয়ে সেহরী পর্যন্ত খাবার-দাবার চলে। এসময় অতিভোজনের ব্যাপারে সজাগ থাকতে হবে। মনে রাখা ভাল রমজান ইবাদতের মাস, আল্লাহর সান্নিধ্যে আসার মাস। তাই এসময় সুস্থ সতেজ থাকাটা অবশ্যই বাঞ্চণীয়। রমজান মাসকে যেন আমরা খাদ্য উৎসবের মাসে পরিণত না করি। খেজুর দিয়ে ইফতার শুরু করা ভাল, প্রতিদিন ২-৩টি খাওয়া যেতেই পারে। খেজুরের অনেক উপকারিতা আছে। দীর্ঘ উপবাসের পর খেজুর শরীরে দ্রুত শক্তি যোগান দেয়। খেজুর সহজ পচ্য-বেশী আঁশ থাকার কারণে পায়খানা পরিস্কার হয়। খেজুর ভিটামিন ও খনিজ লবণ সমৃদ্ধ। খেজুর খেলে অতিরিক্ত খাওয়ার প্রবণতা কমিয়ে দিয়ে অতি ভোজন থেকে রক্ষা করে। সাথে সাথে সরবত যেমন চিনি-লবন-লেবুর সরবত, ইসুপগুলের ভুষির সরবত এবং তাজা ফলের রস খাওয়া খুবই ভাল। দুধ ও ফল দিয়ে বানানো পানীয় যেমন- ব্যানানা শেক, ম্যাংগো শেক ইত্যাদিও রোজা ভাঙ্গার পর শক্তির উৎস হিসেবে ভাল কাজ করে। তারপর সবজী বা চিকেন স্যুপ খাওয়া যেতে পারে। স্বাস্থ্য-সম্মত ভাবে রান্না করা হালিম খাওয়া যেতে পারে। অনেকের ইফতার করার সময় চিড়া-দই-কলা খাওয়ার অভ্যাস আছে। সেটাও চলে। অনেকে কাঁচা বুট খান সেটাও ভাল। আমাদের দেশে বুট, মুড়ি, পিয়াজু এবং বেগুনী ইফতারের একটা অপরিহার্য অংশ। এটা যেন না হলেই চলে না। তবে এব্যাপারে পরিমিত হওয়া ভাল। সব কিছুই স্বাস্থ্য সম্মত ভাবে তৈরী হওয়া উচিত। বুট বা ছোলায় ভিটামিন, খনিজ লবণ ও উচ্চ মানের প্রোটিন থাকে। জিলাপির ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করা ভাল। বিশেষ করে পরিমাণের ব্যাপারে, বিশেষ করে যাদের ডায়াবেটিস আছে বা শরীরের ওজন বেশি। কি তেল দিয়ে ভাজা হচ্ছে সেটাও দেখার বিষয়। মোটকথা অতিরিক্ত ভাজা পোড়া এবং বেশি মিষ্টি জাতীয় খাদ্য ইফতারের সময় পরিহার করা উচিত।
সেহরীর সময় জটিল, শর্করা জাতীয় আঁশ সমৃদ্ধ খাদ্য খাওয়া উচিত। এধরনের খাদ্য ধীরে ধীরে হজম হওয়ার কারণে দীর্ঘ সময় পর্যন্ত শরীরে শক্তি যোগান দেয়। এসময়ে লাল আটার রুটি, ভাত মুল খাদ্য হিসেবে খাওয়া যেতে পারে। সাথে শাক-সবজী, ফল-মূল আঁশযুক্ত খাদ্যের বাড়তি যোগান দেবে। সেহরীর সময় মিষ্টি না খাওয়া ভাল। তাতে খিদে বেড়ে যেতে পারে। বেশী লবণ যুক্ত খাদ্য খেলে পানির পিপাসা বেড়ে যায় বলে রোজা রাখতে কষ্ট হবে। চা-কফি পান করলে প্রস্রাবের পরিমাণ বেড়ে গিয়ে পানি শূণ্যতা দেখা দিতে পারে। বরং সেহরীর সময় তাজা ফলের রস খাওয়া যেতে পারে। সেহরীর সময় তাড়াহুড়া করে বেশী পানি পান না করা ভাল। বরং ইফতার ও সেহরীর মধ্যবর্তীকালীন সময়ে পানি বেশি পান করা শ্রেয়।
তারাবির পর এবং শুইতে যাওয়ার আগে কিছু খাওয়া ভাল। তবে এটা নির্ভর করে পূর্ববর্তী ইফতারের ধরণের উপর। ভারি ইফতার খেয়ে থাকলে এসময়ে হালকা খাবার খাওয়াই ভাল। অনেকে ইফতার কম খেয়ে তারাবির পর বেশি খাবার খেয়ে থাকেন। আবার এই মধ্যবর্তী সময়ে কিছু না খেয়ে সেহরীর সময় ভূড়ি ভোজন করাও ঠিক নয়। এই মধ্যবর্তী সময়কার খাবার-দাবার সেহরীর মতই হবে। যথা জটিল শর্করা জাতীয় খাদ্য, আঁশযুক্ত খাদ্য এবং আমীষ সমৃদ্ধ খাদ্য। সাথে তাজা ফল-মূল, তাজা শাক-সবজিও থাকবে। এই সময় বেশি পানি পান করা যেতে পারে। ডায়াবেটিস, কিডনী রোগ ইত্যাদি বিশেষ বিশেষ অসুখে খাবার-দাবারের ব্যাপারে অভিজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
উপসংহার: রমজান মাস শ্রেষ্ঠ রহমতের মাস। সংযম পালনও সংযম শিক্ষার মাস। এ মাস যেন খাদ্য উৎসবের মাসে পরিণত না হয়। সুষম খাদ্য খেয়ে পরিমিত ভোজন করে শরীরকে সুস্থ-সবল রেখে বেশি বেশি ইবাদত করতে পারাই হবে উত্তম কাজ।