এক মাসের বেশি সময় ধরে তাপপ্রবাহে পুড়ছে সারাদেশ। দেশের বায়ুমন্ডল এবং মাটি এখন প্রচন্ড উত্তপ্ত। খাঁ খাঁ করছে দেশের মাঠ-প্রান্তর। ঘরে-বাইরে সবখানেই বিরাজ করছে অস্বস্তিকর পরিস্থিতি। এমন পরিবেশে রাজধানীতে বাড়ছে পানিবাহিত রোগ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তৃষ্ণা মেটাতে ওয়াসার দূষিত পানির পাশাপাশি রাস্তার পাশে পানিমিশ্রিত আখের রস, লেবুর শরবতের মতো ঠান্ডা পানীয় ও খাবার খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন অনেক পথচারী। রাজধানীর হাসপাতালগুলোতে বাড়ছে ডায়রিয়াসহ নানা ধরনের পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। এ পরিস্থিতিতে পানি ও খাবারের বিষয়ে স্বাস্থ্য সচেতনতার পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকরা। রাজধানীর আইসিডিডিআর’বিতে এক সপ্তাহ ধরে প্রতিদিন ঘণ্টায় গড়ে ২৭ নতুন ডায়রিয়া রোগী ভর্তি হচ্ছে ।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা জানান, তীব্র গরমে রাজধানীতে ডায়রিয়া, আমাশয়, টাইফয়েড, প্যারাটাইফয়েড, জন্ডিস, জ্বর, সর্দি, কাশিসহ পানিবাহিত রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। সিগেলোসিস (ডিসেন্ট্রি), হেপাটাইটিস-এ এবং কলেরাও পানিবাহিত সংক্রামক রোগ। এ বিষয়ে আইসিডিডিআর’বির বৈজ্ঞানিক ডাঃ আজহারুল ইসলাম খান জানান, বিশুদ্ধ পানি নিশ্চিত করা না গেলে এবং তাপমাত্রা বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে নতুন নতুন ডায়রিয়া রোগীর সংখ্যাও বাড়তে থাকবে। পাশাপাশি স্বাস্থ্যের প্রতি সচেতন থাকার জন্য তিনি বিশেষভাবে পরামর্শ দিয়েছেন। পানিবাহিত রোগ প্রতিরোধে নিরাপদ পানি পান এবং নষ্ট ও বাসি খাবার এড়িয়ে চলার পরামর্শ দিয়েছেন জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডাঃ মোস্তাক আহমেদ। তিনি বলেন, বিশুদ্ধ পানি নিশ্চিত করতেই হবে। জীবাণুযুক্ত পানি পান করলে ডায়রিয়া, আমাশয়, টাইফয়েড, জন্ডিস, জ্বর, সর্দি, কাশি, হেপাটাইটিস-এ ও কলেরার মতো জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কাই বেশি থাকে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বিশ্বে প্রতিবছর ১৮ কোটি মানুষ পানিবাহিত রোগে মারা যায়। বিশেষত ডায়রিয়ার কারণে শিশু মৃত্যুহার অনেক বেশি। আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশে শিশুরা পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হয় সবচেয়ে বেশি। সময়মতো এ থেকে সাবধান না হলে বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। মানুষ ও অন্যান্য জীবজন্তুর বিভিন্ন রোগের জন্য প্রধানত দায়ী রোগ সৃষ্টিকারী অণুজীব (ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাস) এবং কয়েক রকমের পরজীবী। এ ধরনের সংক্রামক রোগ সৃষ্টিকারী অণুজীব নানারকম কৌশলের সাহায্যে পরিবেশে বেঁচে থাকে বা বিস্তার লাভ করে। বিস্তার লাভের জন্য তিনটি প্রধান পন্থা হচ্ছে : বাতাস, পানি এবং শারীরিক সংস্পর্শ। শ্বাসনালীর মাধ্যমে দেহে প্রবেশের জন্য বাতাসই মাধ্যমরূপে কাজ করে। অন্য ক্ষেত্রে পরিপাকতন্ত্রের সংক্রমণের মাধ্যম হলো পানি। অনেক সংক্রামক, উদাহরণস্বরূপ ভাইরাস শরীরে প্রবেশ করতে পাকস্থলীকে পথ হিসেবে ব্যবহার করে এবং দ্রুত অভীষ্ট অঙ্গে পৌঁছে পাকস্থলীকে পরিত্যাগ করে।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা জানান, বিশুদ্ধ পানি পান করার মাধ্যমে এ সমস্যা থেকে সহজে রেহাই পাওয়া যায়। এ জন্য ফোটানো বা বিশুদ্ধ পানি পান করতে হবে। পরিষ্কার পাত্রে পানি সংরক্ষণ করতে হবে। খাবার তৈরি এবং খাওয়ার আগে ও পরে হাত ধুয়ে নিতে হবে। এ নিয়ম শিশুদের ক্ষেত্রে আরও বেশি করে কার্যকর করতে হবে। তাদের ছোটবেলাতেই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার শিক্ষা দিতে হবে। ওয়াশরুম ও পায়খানা থেকে বের হওয়ার আগে হাত অবশ্যই ভালভাবে ধুয়ে নিতে হবে। রান্নার আগে খাবার ভালভাবে ধুয়ে নিতে হবে। বাইরে-রাস্তায় খাওয়া-দাওয়া না করে ঘরে বসে ঘরের খাবার খাওয়ার অভ্যাস করতে হবে। আর সর্বদা বিশুদ্ধ পানি পান করতে হবে।
বিশুদ্ধ পানি পান করার পরামর্শ দিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের সাবেক ডিন অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ জনকণ্ঠকে জানান, তাপমাত্রার সঙ্গে ডায়রিয়াসহ বিভিন্ন রোগের জীবাণুর যোগসূত্র রয়েছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলে পানিবাহিত জীবাণুসমূহ বেশি সক্রিয় হয়ে ওঠে। এসব জীবাণু পানির মাধ্যমে সরাসরি শরীরে প্রবেশ করে বিভিন্ন জটিল রোগের কার্যকর বাহক হিসেবে কাজ করে। তাই বিশুদ্ধ পানি পান এবং স্বাস্থ্যসেবার বিষয়ে বেশি সচেতন থাকা দরকার।