কেন সূর্যের আলো স্বাস্থ্যের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ

আপনি পৃথিবীর যে অঞ্চলেই থাকুন, সেখানে দিন যত লম্বা বা ছোটই হোক, কতক্ষণ সময় আপনি দিনের আলোতে থাকছেন তা আপনার শারীরিক-মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আপনি যদি উত্তর গোলার্ধে বাস করেন, তাহলে সেখানে এখন রাত ছোট হচ্ছে আর দিনের দৈর্ঘ্য বাড়ছে। আর যদি আপনি থাকেন দক্ষিণ গোলার্ধে, তাহলে সেখানে ঘটছে এর উল্টোটা। অন্ধকারাচ্ছন্ন মাসগুলোতেও হয়তো আনন্দ খুঁজে পাওয়ার মতো অনেক কিছু আছে- আগুনের উষ্ণতা, আরামদায়ক কম্বল এবং উপাদেয় খাবার। কিন্তু আমাদের স্বাস্থ্য ঠিক রাখার জন্য সূর্যের আলোর কোন বিকল্প নেই। শীত বিদায় নেয়ার পর যে আমরা অনেক বেশি চাঙ্গা এবং সুখী বোধ করি, সেটা সবাই স্বীকার করবেন। আবার গ্রীষ্ম শেষে যখন শীত মৌসুমের দিকে যাত্রা শুরু হয়, তখন আমাদের আবার গ্রাস করে স্থবিরতা।

সূর্যের আলো কীভাবে আমাদের অস্থি হতে শুরু করে মস্তিষ্ক পর্যন্ত সব কিছুর ওপর প্রভাব ফেলে জানা যাক তার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাঃ

১. সূর্যালোক আমাদের শরীরের ২৪ ঘন্টার চক্র নিয়ন্ত্রণ করে

পৃথিবীর নিজের অক্ষের ওপর একবার ঘুরতে সময় লাগে ২৪ ঘন্টা। আমাদের শরীরও নিয়ন্ত্রিত হয় এই ২৪ ঘন্টার চক্রে। ইংরেজিতে এটিকে বলে ‘সার্কাডিয়ান ক্লক।’ আমাদের শরীরের সবকিছু কিন্তু এই চক্র দ্বারা নিয়ন্ত্রিত- আমরা কখন ঘুমাবো, আমাদের শরীরের মেটাবলিজম থেকে শুরু করে কখন আমাদের দেহ থেকে হরমোন নিঃসৃত হবে, সবকিছু। এখন ধরা যাক আমাদের শরীর সূর্যালোক থেকে পুরোপুরি বঞ্চিত। তারপরও কিন্তু আমাদের শরীরের এই ২৪ ঘন্টার চক্র অপরিবর্তিত থাকবে। বিজ্ঞানীরা অন্ধকার গুহায় দীর্ঘদিন বাস করে সেটা পরীক্ষা করে দেখেছেন। কিন্তু তারপরও আমাদের শরীর আসলে সূর্যালোকের সংস্পর্শে আসলে দারুণভাবে সাড়া দেয়। এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ এক সংকেত যা আমাদের দেহের অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ শুরু করতে সাহায্য করে

২. আলো আমাদের ঘুমাতে এবং জাগাতে সাহায্য করে

আমাদের ঘুমিয়ে যেতে এবং জাগিয়ে তুলতে আলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যখন অন্ধকার ঘনিয়ে আসে তখন আমাদের শরীর থেকে মেলাটোনিন নিঃসৃত হয়। এটি আমাদের ঘুমাতে সাহায্য করে। অনেক এয়ারলাইন্স এখন তাদের উড়োজাহাজের কেবিনে এমন ধরণের লাইটিং ব্যবহার করে, যেটি জেট-ল্যাগ কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করে। বোর্ডিং-এর জন্য তারা ব্যবহার করে উজ্জ্বল আলো। ডিনার খাওয়ার সময় হালকা আলো। এরপর বিশেষ আলো ব্যবহার করে সূর্যাস্তের বিভ্রম তৈরি করা হয়, যাতে করে যাত্রীরা ঘুমিয়ে পড়েন।

৩. অনিদ্রা দূর করতেও সাহায্য করে আলো

কম্পিউটার, ট্যাবলেট এবং স্মার্টফোন থেকে যে নীল আলো বিচ্ছুরিত হয়, তা ঘুমের জন্য প্রয়োজনীয় হরমোন নিঃসরণের পথে বাধা। বিশ্বের অনেক দেশের স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষই তাই এখন ঘুমাতে যাওয়ার কিছু সময় আগে থেকেই এসবের ব্যবহার বন্ধ রাখতে পরামর্শ দেয়। সবচেয়ে ভালো যদি এগুলোকে বেডরুমের বাইরে রাখা যায়। ঘুম নিয়ে গবেষণা করছেন নিউরোসায়েন্টিস্ট ম্যাথিউ ওয়াকার। তিনি মনে করেন আমাদের ঘুমের ছন্দ ঠিক রাখতে দিনের আলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যাদের রাতে ঘুমাতে বেগ পেতে হয়, তাদের জন্য সকালের একঘন্টার সূর্যালোক ম্যাজিকের মতো কাজ করতে পারে। এটি আমাদের বডি ক্লক বা দেহঘড়িকে সঠিক ছন্দে নিয়ে আসে এবং বিছানায় যাওয়ার পর আপনাকে ঘুমকাতুরে করে তোলে।

৪. আলো আমাদের মন-মেজাজকে প্রভাবিত করে

আমাদের প্রতিদিনের ঘুমের প্যাটার্ন ঠিক রাখার জন্য একটা নির্দিষ্ট সময় দিনের আলোতে থাকা শুধু গুরুত্বপূর্ণই নয়, এই আলো আমাদের মস্তিষ্কে এমন কিছু পরিবর্তন নিয়ে আসে যা আমাদের মন-মেজাজ ভালো রাখে। যখন শরীর দিনের আলো ফুটেছে বলে টের পায়, আমাদের অপটিক নার্ভ দিয়ে এই আলোর সংকেত যখন মস্তিষ্কে পৌঁছায়, তখন সেরোটোনিন নামের একটি রাসায়নিক নিঃসৃত হয়। সেরোটনিন আমাদের মন-মেজাজ ফুরফুরে রাখে। আর যারা পর্যাপ্ত দিনের আলো থেকে বঞ্চিত, যাদেরকে রাতের পালায় কাজ করতে হয়, তাদের অনেক সময় বিষণ্নতায় ভুগতে দেখা যায়। দিনের আলোর সঙ্গে সিজনাল এফেক্টিভ ডিজঅর্ডার (স্যাড) বলে একটি মানসিক অবস্থার সরাসরি সম্পর্ক আছে। শরতে যখন দিন ছোট হতে শুরু করে, তখন থেকে শীতকাল পর্যন্ত এর প্রকোপ বাড়ে। কিন্তু বসন্তের সময় থেকে এটি কমতে থাকে।

এজন্যে যারা এই মানসিক বিষাদের সমস্যায় ভোগেন, তাদের জন্য একধরণের উজ্জল আলো ব্যবহারের পরামর্শ দেয়া হয়, যা স্যাড ল্যাম্প নামে পরিচিত। এটির আলো দিনের আলোর মতই দেখতে। সকাল বেলায় আধা ঘন্টার মতো এরকম আলোতে কাটালে আমাদের দেহঘড়ির ছন্দ ঠিক হয়ে যায় এবং আমাদের মানসিক অবস্থা ভালো রাখতে সাহায্য করে।

৫. সূর্যের আলো আমাদের হাড় শক্ত রাখতে সাহায্য

ভিটামিন ডি আমাদের শরীরের জন্য খুবই দরকার। বিভিন্ন খাবার থেকে ক্যালসিয়াম এবং ফসফেট আমাদের শরীরের শোষণ করতে সাহায্য করে সূর্যালোক। আমাদের হাড়, দাঁত এবং পেশীকে শক্ত এবং সুস্থ রাখতে এটা খুবই দরকার।

ভিটামিন ডি-র অভাব হলে হাড় দুর্বল এবং নরম হয়ে পড়ে, নানা সমস্যা দেখা দেয়। সূর্যের আলো থেকেই কিন্তু আমরা আমাদের শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় সব ভিটামিন ডি পেতে পারি। যখন আমাদের দেহত্বকে রোদ এসে পড়ে, তখন শরীর সেখান থেকে ভিটামিন ডি তৈরি করে। তবে খুব বেশি রোদ আবার ক্ষতি করতে পারে, এজন্যে সানস্ক্রিন ব্যবহার করা দরকার। আর দুপুরে যখন সূর্যের তেজ সবচেয়ে বেশি, তখন রোদে না যাওয়াই ভালো।

About Post Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *