স্বাস্থ্য ও উন্নয়ন একসূত্রে গাঁথা। সরকার স্বাস্থ্য খাতকে প্রাধান্য দিয়ে দারিদ্র্য দূরীকরণ, নারীর ক্ষমতায়ন, লিঙ্গ সমতা, শিক্ষা, মাতৃস্বাস্থ্যসেবা, শিশুমৃত্যু হ্রাস ও পরিবার পরিকল্পনাসহ অন্যান্য কর্মসূচি বাস্তবায়ন করলেও দূঃখজনক হল, গত কয়েক বছরে পানি, স্যানিটেশন ও স্বাস্থ্য (ওয়াশ) খাতে সরকারি বরাদ্দের পরিমাণ অর্ধেকের নিচে নেমে এসেছে।
এর ফলে দেশের মানুষ, বিশেষ করে দরিদ্ররা পানিবাহিত ছাড়াও অন্যান্য রোগ-ব্যাধির শিকার হচ্ছে এবং এটি জাতীয় উন্নয়নের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। পানি ও স্যানিটেশন ব্যবস্থা কাক্সিক্ষত মানে উন্নীত না হওয়ায় আমাদের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা বিনষ্ট হচ্ছে, যা মেনে নেয়া কষ্টকর।
বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন সংক্রান্ত রোগে বাংলাদেশের ধনী শ্রেণীর তুলনায় দরিদ্ররা তিনগুণ বেশি ভোগান্তির শিকার হচ্ছে। দরিদ্র পরিবারের, বিশেষ করে শিশুদের অপুষ্টির শিকার হওয়ার প্রবণতার সঙ্গে পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার দুর্বলতার সরাসরি সংযোগ থাকার বিষয়টি স্পষ্ট হওয়ায় নিরাপদ পানি সরবরাহের ব্যাপারে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া উচিত- এ বাস্তবতা সামনে রেখে ওয়াটার এইড-এর আর্থিক সহযোগিতায় ইকো-সোস্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (ইএসডিও) মিরপুর এলাকার শহীদবাগ বস্তি, কল্যাণপুর পোড়াবস্তি, বাউনিয়া বাঁধ বস্তি ও টেকেরবাড়ি বস্তিতে বসবাসকারী নিুআয়ের ও সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠী, বিশেষ করে গার্মেন্টস কর্মী এবং এ এলাকার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিরাপদ পানি ও উন্নত স্যানিটেশন সুবিধা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কাজ করছে। এর পাশাপাশি স্বাস্থ্যাভ্যাস চর্চার বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং নারী ও কিশোরীদের অংশগ্রহণ ও ক্ষমতায়নের মাধ্যমে টেকসই স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ নিশ্চিত করার ব্যবস্থাও গ্রহণ করা হয়েছে।
এপ্রিল ২০১৮ থেকে মার্চ ২০২১ সময়সীমার মধ্যে ‘অ্যাড্রেসিং ওয়াশ ক্রাইসিস ইন লো-ইনকাম স্যাটেলমেন্টস অব গার্মেন্টস ওয়ার্কার ইন মিরপুর, ঢাকা- এ প্রকল্পের আওতায় স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট ও নিরাপদ খাবার পানির উৎস নিশ্চিত করার মাধ্যমে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর নিরাপদ পানি, স্বাস্থ্য ও স্যানিটেশন অভিগম্যতা উন্নত করার পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। এ প্রকল্পের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যগুলোর মধ্যে অন্যতম হল-
১. বস্তি এবং স্কুলে নিরাপদ পানীয় জলের অভিগম্যতা বৃদ্ধি, উন্নত স্যানিটেশন ও স্বাস্থ্যসম্মত আচরণবিধি সম্পর্কিত চর্চা বাড়ানো।
২. বস্তিবাসীর স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কিত আচরণ পরিবর্তনের জন্য কিশোরীদের ‘পরিবর্তন প্রতিনিধি’ হিসেবে তৈরি করা।
৩. কমিউনিটিতে টেকসই নিরাপদ পানি, স্যানিটেশন, স্বাস্থ্যবিধি ও সেবা নিশ্চিতকরণে ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তা দল তৈরি করা ইত্যাদি।
প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে অন্তত ৫ হাজার ৪০০ মানুষ নিরাপদ পানি সুবিধার আওতায় আসবে; ৬ হাজার মানুষ উন্নত টয়লেট ব্যবহারের আওতায় আসবে এবং ১০ হাজার মানুষ সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার অভ্যাসসহ ঋতুকালীন স্বাস্থ্য পরিচর্যার ব্যবস্থাপনা, শিশুর মলের নিরাপদ ব্যবস্থাপনা এবং নিরাপদ পানি ব্যবস্থাপনা ও তা সঠিক উপায়ে পালনের ধারণা লাভ করবে।
বস্তি এলাকার পাশাপাশি ওয়াটার এইড-এর আর্থিক সহযোগিতায় প্রকল্পটি কালশী ইসলামিয়া উচ্চ বিদ্যালয়েও বাস্তবায়ন করেছে ইকো-সোস্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (ইএসডিও)। ফলে এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ওয়াটার ও স্যানিটেশন ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন হয়েছে। এ বিদ্যালয়ের ১ হাজার ৮৬ জন ছাত্রছাত্রী নিরাপদ খাবার পানির পাশাপাশি উন্নত ও পরিচ্ছন্ন টয়লেট ব্যবস্থাপনার আওতায় এসেছে।
এটি নিঃসন্দেহে তাদের পড়ালেখায় ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে। এ প্রসঙ্গে বিদ্যালয়টির সহকারী শিক্ষক হাসিনা আক্তার জানালেন, আগে যারা বাসা থেকে পানি বয়ে আনত, তারা এখন স্কুলেই খাবার পানি পাচ্ছে। নবম শ্রেণীর ছাত্রী ফাহিমা তার অভিজ্ঞতার বর্ণনা করল এভাবে- স্যার হয়তো বেসিনে গিয়ে সাবান না পেয়ে বললেন, সাবান কোথায় গেল? তখন দূর থেকে আমরা বলি, হাত ধুয়েছি স্যার; ব্যবহার করেছি।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এ কেএম বজলুর রহমান বললেন, ইএসডিও-র বাস্তবায়নকৃত এ প্রকল্পের মাধ্যমে এর ইতিবাচক জ্ঞান ও অভ্যাসগুলো শুধু আমার স্কুলে নয়; এগুলো ছড়িয়ে যাবে প্রত্যেক ছাত্রছাত্রীর পরিবারেও। আসলেই তাই। এভাবে একদিন হয়তো দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রতিটি পরিবারে স্বাস্থ্যাভ্যাস চর্চার বার্তা পৌঁছে যাবে এবং এর ফলে সচেতনতা বৃদ্ধিসহ নারী ও কিশোরীদের অংশগ্রহণ ও ক্ষমতায়নের মাধ্যমে টেকসই স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ নিশ্চিত হবে।