কোহিনুর আকতার নামের একজন অভিযোগ করেন, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১৬ মার্চ দুপুরে চর্ম ও যৌনরোগ বিভাগে তাঁর মা শাকেরা বেগমকে ভর্তি করান। ভর্তির দিন তিনি যে মহিউদ্দিনকে ওয়ার্ডের মেঝে পরিষ্কার করতে দেখেন, ১৮ মার্চ দুপুরে সেই সুইপার তাঁর মায়ের হাতে ইনজেকশন পুশ করেন। এতে রোগীর হাত ফুলে যায়। ভাগ্যিস, ওই ফোলার ওপর দিয়ে গেছে, আর কিছু হয়নি!
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অবশ্য বলছে যে ওই সুইপারকে হাসপাতালে আসতে নিষেধ করা হয়েছে। তাঁকে আগেই বাদ দেওয়া হয়েছিল। এরপরও লোকবল-সংকটের কারণে জ্যেষ্ঠ চিকিৎসকেরা ব্যক্তিগত কাজে লাগাতেন। কর্তৃপক্ষের দায়িত্বজ্ঞানহীনতা ও সুইপারের দুঃসাহস দেখে ভিরমি খেতে হয়। লোকবল থাকবে না বলে কি ইনজেকশন দেওয়ার লোকের এতই অভাব? কে দেবে এর জবাব? জবাবদিহিই–বা করবে কে?
সাধে কি আর জসীমউদ্দীন তাঁর ‘বাঙ্গালীর হাসির গল্প’ বইয়ে ফোড়া কাটা নাপিতের গল্পটি জুড়েছেন? ছোট এক শহরে কারও ফোড়া হলে সেই নাপিত তার ত্রাণকর্তা। ফোড়ার গোড়া নাশে নরুন আর ক্ষুর নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে সে। ঘ্যাঁচাঘ্যাঁচ ফোড়া কেটে একটুখানি হলুদের গুঁড়া মাখিয়ে দেয়, আর ওতেই ফোড়া ফুঁ। এমন ‘নাপিত ডাক্তার’ থাকতে পাস করা ডাক্তারের কাছে কে যায়? শুধু শুধু টাকার শ্রাদ্ধ। দিন দিন তার প্রসার জমে উঠল। পাস করা সব ডাক্তারের মাথায় হাত। পরে অবশ্য কায়দা-কৌশল করে নাপিতের মাথা থেকে চিকিৎসকের ভূতটাকে নামানো গিয়েছিল।
কিন্তু আমাদের দেশে ‘নাপতে বুদ্ধি’ রাখা ভুয়া চিকিৎসককে সাইজে আনা কঠিন। তারা অতি সেয়ানা। তারা কেবল রোগীর মাথায় কাঁঠালই ভাঙে না, কোয়া খেয়ে আঠাও লাগায় অন্যের মুখে। এমন ঘটনা ভূরি ভূরি।
গত জানুয়ারিতে ডেইলি স্টারের অনলাইন বাংলা সংস্করণে ‘আসল ডাক্তারের নামে নকল ডাক্তার!’ শীর্ষক খবরে এমনই এক ভুয়া চিকিৎসকের তথ্য তুলে ধরা হয়। পাবনার ভাঙ্গুরায় চিকিৎসাসেবায় নিয়োজিত এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে, তিনি ময়মনসিংহ মেডিকেল থেকে পাস করা মাসুদ করিম নামের এক চিকিৎসকের পরিচয় ও নিবন্ধন ব্যবহার করে স্থানীয় একটি হেলথ কেয়ারে কাজ করছেন। টানা সাত বছর ধরে এই ‘ভয়ংকর’ কাণ্ড চালিয়ে যাওয়ার পর তা সবার নজরে আসে। পরে তিনি গা ঢাকা দেন।
এমন খবর সংবাদমাধ্যমে প্রায়ই আসে। মুখোশ খুলে যাওয়ার পর ‘ভুয়া চিকিৎসক’ হয় বেমালুম ভেগে যান, নয়তো জেল-জরিমানা হয়। দেড়-দুই বছর আগে সাতক্ষীরা শহরে মনোয়ার হোসেন সরদার নামের এমন এক ভুয়া চিকিৎসককে গ্রেপ্তার করা হয়, যিনি খুলনা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক ও বিশিষ্ট ক্যানসার সার্জারি মনোয়ার হোসেনের নাম ব্যবহার করে প্রতারণা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। আসলে তিনি ছিলেন হিসাবরক্ষণ অফিসের সাবেক কর্মচারী। এক লাখ টাকা জরিমানা ও মুচলেকা দিয়ে রক্ষা পান তিনি।
ভাবছি, এই সুইপার আবার সে রকম কোনো ডাক্তার সেজে না বসেন? ইনজেকশন মারার বিদ্যেটা যখন রপ্ত হয়েছে, তখন ভুয়া পরিচয়ে চেম্বার খুলতে বা কোনো ওষুধের দোকানে বসতে সমস্যা কী?
বাণিজ্য জমে উঠলে লক্ষ্মীর ভান্ডার এমনি খুলে যায়। আর জুতসই দক্ষিণা দিয়ে কর্তৃপক্ষ তথা আইনের লোকজন পকেটে পুরা কোনো ব্যাপার? আইনের লেবাসধারী কিছু ব্যক্তি থাকেনই ওত পেতে—কোথায় ছোঁ মারা যায়।
এই তো, পাসপোর্ট ভেরিফিকেশনের জন্য উচ্চ আদালতের এক বিচারপতির স্ত্রীর কাছে ঘুষ দাবির মামলায় ধরা খেয়ে গেছেন স্পেশাল ব্রাঞ্চের এএসআই সাদেকুল ইসলাম। দুই বছরের সাজা হয়েছে তাঁর। তবে সবাই কি আর এভাবে ফাঁসেন? দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের জন্য ‘ভুয়া’ লোকজন দুপয়সা কামানোর জবর উৎস।
তবে দোষ কি শুধু ওই সুইপারেরই? যাঁরা তাঁকে অবলীলায় ইনজেকশন পুশ করার সুযোগ দিচ্ছেন, তাঁরা দায় এড়াবেন কী করে? চিকিৎসক আর হাসপাতালের হর্তাকর্তারা দায়িত্ব পালনে উদাসীন এবং কর্তব্য পালনে অবহেলা করলে চিকিৎসা পরিস্থিতির হাল কী হয়, এর সুনিপুণ চিত্র পাওয়া যায় প্রথিতযশা কথাশিল্পী হাসান আজিজুল হকের ‘পাতালে হাসপাতালে’ শীর্ষক গল্পে।
গল্পের প্রধান চরিত্র জমিরুদ্দি তার সংক্রমিত ফোলা পা নিয়ে সরকারি হাসপাতালে এসে ভর্তি হয়। পায়ের অবস্থা ক্রমে খারাপ হতে থাকে। কোনো চিকিৎসা হয় না। সারা হাসপাতাল রোগীতে গিজগিজ, জরুরি অস্ত্রোপচারের অপেক্ষায় পড়ে আছে একগাদা রোগী, কিন্তু চিকিৎসকদের তাগিদ নেই। তাঁরা বরং বেতন, স্কেল আর দুর্মূল্যের বাজার সামলানো নিয়ে উদ্বিগ্ন। এটা ৩০ থেকে ৪০ বছর আগের পরিস্থিতি। এখন অবশ্য সে পরিস্থিতি নেই।
সারা দেশেই সরকারি হাসপাতালগুলোর যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। চিকিৎসকেরা সরকারি নিয়ম অনুয়ায়ী ভালো বেতন-ভাতা পান। অন্যান্য সুযোগ-সুবিধাও কম নেই। আধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থার সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের দেশের চিকিৎসাও অনেক এগিয়েছে। এখন উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দেশেই জটিল সব রোগের সফল চিকিৎসা দিচ্ছেন। হার্ট ও কিডনির সমস্যার বড় ধরনের অস্ত্রোপচার দেশেই হচ্ছে। পেশাগত দক্ষতার জন্য সুনামও রয়েছে বেশ কজন চিকিৎসকের। এসব চিকিৎসকের পাশাপাশি নার্স বা চিকিৎসার অন্যান্য ক্ষেত্রের জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষিত লোকজনও কম নেই। কাজেই কিছুতেই মাথায় খেলে না, একটি সরকারি হাসপাতালে লোকবলের অভাব হবে কেন, আর একজন সুইপারকেই–বা ইনজেকশন দিতে হবে কেন?