ভীষণ ব্যস্ত সময় পার করছেন ক্রাইস্টচার্চের চিকিৎসকরা

দুর্যোগ সামাল দেওয়ার দক্ষতা রয়েছে নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চ শহরের চিকিৎসকদের। তবে এসব চিকিৎসকরা এবার মসজিদের হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় অনেকটাই কিংকর্তব্যে বিমূড় হয়ে গিয়েছিলেন। কারণ এমন একটি দেশে তাঁরা বাস করেন, যেখানে বছরে হত্যাকাণ্ডের সংখ্যাই সব মিলিয়ে ৫০ ছাড়ায় না। সেদিনের হতাহতদের নিয়ে কঠিন এক সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন ক্রাইস্টচার্চের চিকিৎসকরা।

বার্তা সংস্থা এএফপি জানিয়েছে, আহতদের রক্তপাত বন্ধে, বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া শরীরের বিভিন্ন অংশ জোড়া দিয়ে জীবন বাঁচাতে সেখানার চিকিৎসক, শল্য চিকিৎসক আর নার্সরা ২৪ ঘণ্টা খেটে চলেছেন। 

ক্রাইস্টচার্চের হাসপাতালে গতকাল রোববার গুলি খাওয়া রোগীর সংখ্যা ছিল ৩৪ জন। এর মধ্যে ১২ জনের অবস্থা গুরুতর। আহতদের মধ্যে এক শিশুর বয়স চার বছর। এলিন আরসাতি নামের এই শিশুকে পাঠানো হয়েছে অ্যাকল্যান্ডের হাসপাতালে উন্নত চিকিৎসার জন্য। হাসপাতালের নিবিড় সেবা ইউনিটে (আইসিইউ) রাখা হয়েছে শিশুটিকে।

ক্রাইস্টচার্চ হাসপাতালের প্রধান শল্য চিকিৎসকের নাম গ্রেগ রবার্টসন সাংবাদিকদের সঙ্গে ঘটনার ভয়াবহতা নিয়ে কথা বলেন। দুর্ঘটনার দিন হাসপাতালে আহতদের ঢল নামার কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, ‘শুরুতেই তীব্র আতঙ্কিত হয়ে উঠেছিলাম আমরা। তারপর স্তম্ভিত সবশেষে ক্ষুব্ধ।’

তিনি জানান, প্রথম দিকে ব্যক্তিগত গাড়িতে করে আহতরা আসছিলেন। পরে লাইন ধরে অ্যাম্বুল্যান্স আসতে শুরু করে।

তবে এত হতাহতের ঘটনা এই শহরের জন্য এটিই প্রথম নয়। ২০১০ সাল ও ২০১১ সালে লাগাতার ভূমিকম্পে নিহত হয় ১৮০ জনের বেশি। আহত হয় এর কয়েক গুণ বেশি মানুষ। এসব মোকাবেলা করে চিকিৎসকরা এখন অনেক বেশি দক্ষ। 

রবার্টসন বলছিলেন, ‘কোনো সন্দেহ নেই ভূমিকম্পের কারণে আমাদের মধ্যে এক ধরনের দক্ষতা তৈরি হয়েছে। অনুশীলনেই দক্ষতা আসে। আমাদের ক্ষেত্রেও বিষয়টি ব্যতিক্রম নয়। তবে ব্যতিক্রমটা হচ্ছে, ভূমিকম্পের নিয়ন্ত্রণ আমাদের হাতে নেই। কিন্তু একটা লোক এসে আমাদের জনগণ, আমাদের বন্ধু, আমাদের সহকর্মীদের এভাবে খুন করবে—এটা অবিশ্বাস্য মনে হয়।’

তিনি আরো বলেন, গুলিতে আহতদের চিকিৎসা করার অভিজ্ঞতা তাঁর দলের আছে। তবে এতো বেশি গুলিবিদ্ধ রোগী তারা আগে কখনো দেখেননি। আহতদের অনেককেই একই যন্ত্র দিয়ে কয়েকবার অস্ত্রোপচার করতে হয়েছে, এমন ঘটনাও শুক্রবারের পর থেকে ঘটেছে। যেখানে এই হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারের সংখ্যাই মাত্র তিনটি। শুক্রবার আরো চারটি অপারেশন থিয়েটার তৈরি করে নেওয়া হয়। এই সাতটিতেই ২৪ ঘণ্টা কাজ করে যাচ্ছেন চিকিৎসকরা।

ওই দিন প্যারামেডিক সেবা দিয়েও বহু রোগীর প্রাণ বাঁচানো হয়েছে। পাকিস্তানের মোহাম্মদ আমিন নাস তাদেরই একজন। 

তাঁর ছেলে ইয়াসির আমিন জানান, শুরুতেই তাঁরা হামলাকারীর বন্দুকের মুখে পড়েন। তাঁরা মসজিদে ঢোকার সময় গাড়ি থেকে বের হয়ে গুলি ছুড়তে শুরু করে হামলাকারী। তাঁর বাবার শরীরে চারটি গুলি লাগে। 

ইয়াসির জরুরি সেবা সংস্থায় ফোন করলে তারা ঘটনাস্থলে পৌঁছে তাঁর বাবাকে ১০ মিনিট শুশ্রূষা করে। এরপর হাসপাতালে নেওয়া হয় তাঁকে। এরপর তিন দফা অস্ত্রোপচার হয়েছে। এখনো তিনি আইসিইউতে। 

রবার্টসন বলছিলেন, টারেন্ট এমনভাবে অস্ত্র বাছাই করেছিলেন, যেন সহজে সর্বোচ্চসংখ্যক মানুষ খুন করা সম্ভব হয়। এ ধরনের আহতদের চিকিৎসা দেওয়া চিকিৎসকদের জন্যও দুঃস্বপ্নের মতো। 

তিনি বলেন, ‘ভূমিকম্পের সময়ও আমরা দেখেছি, ঘটনার সময় আমরা কাজ করে যাই। পরে আমাদের দীর্ঘকালীন মানসিক বৈকল্য গ্রাস করে। এখন সবাই জীবন বাঁচাতে ব্যস্ত। তবে পরিস্থিতি যখন স্বাভাবিক হবে আপনি বাড়ি ফিরবেন। তখন এই দুঃসহ স্মৃতিগুলো আপনার ওপর জেঁকে বসবে।’ 

গত শুক্রবার নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চের দুটি মসজিদে সন্ত্রাসী হামলায় নিহত হয়েছেন ৫০ জন। এতে আহত হন প্রায় অর্ধশত মানুষ। ওই হামলায় এ পর্যন্ত চারজন বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন বলে নিশ্চিত হতে পেরেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তবে নিহতের সংখ্যা বেড়ে ৮ হতে পারে বলে শঙ্কা রয়েছে।

About Post Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *