শিক্ষক সংকট, শিক্ষার মান প্রশ্নবিদ্ধ

শিক্ষক সংকট থাকায় সরকারি মেডিকেল কলেজগুলোয় পাঠদান ব্যাহত হচ্ছে। এ ছাড়া চিকিৎসা শিক্ষার সিলেবাস আধুনিকায়ন না হওয়ার অভিযোগ আছে। শিক্ষার মান প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ায় বেসরকারি মেডিকেল থেকে গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করা চিকিৎসকদের মান নিয়ে রয়েছে নানা অভিযোগ।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে দেশে ৩৬টি সরকারি মেডিকেল কলেজে শিক্ষা কার্যক্রম চলমান রয়েছে। সরকারি মেডিকেল কলেজে ৫ হাজার ৫৮২ পদের বিপরীতে কর্মরত রয়েছেন ১ হজার ৩০৩ জন শিক্ষক।  

শূন্য পদের সংখ্যা ৪ হাজার ২০৭। খুলনা মেডিকেলে ৬ ব্যাচে শিক্ষার্থী সংখ্যা ৮৬১ জন। কিন্তু ১৯টি বিভাগে কোনো অধ্যাপক নেই। নয়টি বিষয়ে মাত্র একজন করে শিক্ষক থাকলেও চারটি বিষয়ে তাও নেই। ২৩ জন অধ্যাপকের মধ্যে আছেন মাত্র ৪ জন। ৪৪ সহকারী অধ্যাপক পদের বিপরীতে দায়িত্বে আছেন মাত্র আট জন।
পাবনা মেডিকেল কলেজে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ফিজিওলজি, এনাটমি ও বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগ চলছে মাত্র একজন প্রভাষক দিয়ে।

কোনো অধ্যাপক ছাড়াই চলছে পটুয়াখালী মেডিকেল কলেজ। পাঁচ শিক্ষাবর্ষের ২৩৭ শিক্ষার্থীর পাঠদান চলে মাত্র সাতজন প্রভাষক দিয়ে। গত বছরের ১৩ ডিসেম্বর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (চিকিৎসা শিক্ষা ও স্বাস্থ্য জনশক্তি উন্নয়ন) অধ্যাপক ডা. মো. আবদুর রশীদ স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে চিকিৎসা শিক্ষায় মৌলিক বিষয়ের সংকট দূরীকরণের কথা বলা হয়। চিঠির তথ্যে দেখা যায়, বর্তমানে দেশে ৩৬টি সরকারি মেডিকেল কলেজে শিক্ষা কার্যক্রম চলমান রয়েছে। 

এর মধ্যে ২১টিতে মেডিকেল কলেজে অনুমোদিত মৌলিক পদের অধিকাংশই পূর্ণ হয়নি। পরবর্তী ধাপে স্থাপিত ১৫টি মেডিকেল কলেজে দৃশ্যমান কোনো পদ সৃষ্টি হয়নি। চিঠিতে আরও উল্লেখ করা হয়, মেডিকেল শিক্ষা ব্যবস্থায় যেসব চিকিৎসক ক্লিনিক্যাল সাবজেক্টের সঙ্গে জড়িত তারা অফিস-পরবর্তী প্রাইভেট প্র্যাকটিসের মাধ্যমে আর্থিক সুবিধা গ্রহণ করেন। কিন্তু এনাটমি, ফিজিওলজি, ফার্মাকোলজি, ফরেনসিক মেডিসিন, কমিউনিটি মেডিসিনের চিকিৎসকরা বিষয়ভিত্তিক পড়াশোনার জন্য এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত হন। ফলে এই ৮টি বিষয়ে মেডিকেল গ্র্যাজুয়েটদের আগ্রহ কম থাকে।’

সিডনির ইউনিভার্সিটি অব নিউ সাউথ ওয়েলস’র সাবেক সিনিয়র লেকচারার বর্তমানে নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবুল হাসনাৎ মিলটন বলেন, আমাদের দেশের মেডিকেল শিক্ষা পদ্ধতি এখনো অনেক পুরনো। সিলেবাস আধুনিকায়নে নজর দেওয়া জরুরি। সিলেবাসে রোগীর ব্যবহার বিষয়ে কোনো ধরনের বিষয় অন্তর্ভুক্ত নেই। এজন্য তাদের সমাজবিজ্ঞান ও মনোবিজ্ঞান বিষয়ে ধারণা দেওয়া উচিত।

তিনি আরও বলেন, আমরা বিদেশি চিকিৎসকদের বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণা থেকে ধারণা নেই। তাদের লেখা বই পড়ে জ্ঞানার্জন করি। কিন্তু আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে রোগ জীবাণু এবং ওষুধ নিয়ে গবেষণা করার আগ্রহ দেখা যায় না। এ বিষয়ে নজর না দিলে পরিপূর্ণ চিকিৎসক গড়ে উঠবে না।

মেডিকেল শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ অংশ বাস্তব প্রশিক্ষণ। এজন্য ৫০ আসনের একটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ২৫০ শয্যার আধুনিক হাসপাতাল থাকা বাধ্যতামূলক। হাসপাতালের ৭০ শতাংশ শয্যায় আবার সার্বক্ষণিক রোগী ভর্তি থাকতে হয়। যদিও বেসরকারি অনেক মেডিকেল কলেজেই শর্ত মেনে হাসপাতাল নেই। থাকলেও রোগী অনুপস্থিত। প্রতি ১০ জন শিক্ষার্থীর বিপরীতে একজন শিক্ষকের নিয়মও লঙ্ঘিত হচ্ছে।

অভাব রয়েছে আধুনিক শিক্ষা সরঞ্জামের। এসব অপ্রতুলতার মধ্যেই বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলো থেকে প্রতি বছর বের হচ্ছে ছয় হাজারের বেশি চিকিৎসক। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে, এসব চিকিৎসকের মান নিয়ে। শুধু মানহীন নয়, চাহিদার উদ্বৃত্ত চিকিৎসকও তৈরি করছে বেসরকারি এসব মেডিকেল কলেজ। দেশে চিকিৎসকের চাহিদা ও জোগান নিয়ে একটি গবেষণা পরিচালনা করেছে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস)।

এ ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. কামরুল হাসান খান বলেন, মেডিকেল গ্রাজুয়েটদের পাঠদান ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিক্ষক স্বল্পতার কারণে। এ ছাড়া বেশকিছু মেডিকেল কলেজের পাঠদানের মান নিয়ে অভিযোগ রয়েছে। অনেক মেডিকেল কলেজে শিক্ষার্থীদের পর্যাপ্ত রোগী দেখার ব্যবস্থাও করা হয় না। অথচ এটা তাদের সিলেবাসের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তিনি বলেন, বেসরকারি মেডিকেলের পাঠদানের মান নিয়ে বেশকিছু অভিযোগ রয়েছে। এসব অভিযোগ তদন্ত করে প্রমাণ পেলে তাদের কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া উচিত।

About Post Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *