ডায়াবেটিস ও মুখের রোগ

পুরুষ- মহিলা সবাই ব্যাপক হারে ডায়াবেটিস রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। বর্তমানে ১৯৯ মিলিয়নের উপরে মহিলারা ডায়াবেটিস নিয়ে বসবাস করছেন। ২০৪০ সালে এ সংখ্যা দাঁড়াবে ৩১৩ মিলিয়নে। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত প্রতি পাঁচ জন মহিলার মধ্যে দুই জনের ডায়াবেটিস হয়ে থাকে প্রজননকালীন বয়সে। সারা বিশ্বে এ সংখ্যা ৬১ মিলিয়ন। সারা বিশ্বে মহিলাদের মৃত্যুর কারণগুলোর মধ্যে ডায়াবেটিসের অবস্থান নবম যার কারণে ২.১ মিলিয়ন মহিলা মৃত্যুবরণ করে থাকেন। মহিলাদের মধ্যে যাদের টাইপ-২ ধরণের ডায়াবেটিস রয়েছে তাদের ডায়াবেটিস মুক্ত স্বাভাবিক মহিলাদের চেয়ে ১০ গুন বেশি ঝুঁকি রয়েছে করোনারী হৃদরোগ হওয়ার ক্ষেত্রে। মহিলাদের মধ্যে যাদের টাইপ-১ ধরণের ডায়াবেটিস রয়েছে তাদের ঝুঁকি রয়েছে মিসক্যারেজ অথবা গঠনগত ত্রুটি সম্পন্ন শিশু জন্ম হওয়ার ক্ষেত্রে। 

মানব দেহে অগ্ন্যাশয়ের আইলেটস্ অব ল্যাঙ্গারহ্যান্স এর বিটা সেল থেকে ইনসুলিন নিঃসৃত হয়। ইনসুলিন কার্বোহাইড্রেট বা চিনি জাতীয় খাদ্যের বিপাক ক্রিয়ায় সহায়তা করে থাকে। কোন কারণে বিটা সেল এর কার্যকারিতা কমে গেলে বা অগ্ন্যাশয়ের কোনো রোগে ইনসুলিন নিঃসরণ কমে যায় বা একেবারে বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তখন শর্করা বা চিনি জাতীয় খাদ্যের বিপাক ক্রিয়া ব্যাহত হয় এবং ক্রমান্বয়ে ডায়াবেটিস দেখা দেয়।

ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে না রাখলে মাঢ়ি রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি পায়। টাইপ-১ এবং টাইপ-২ উভয় ধরণের ডায়াবেটিস রোগের ক্ষেত্রে মাঢ়ির নানাবিধ সমস্যা দেখা দেয়। তবে তুলনামূলকভাবে টাইপ-২ ডায়াবেটিক রোগীদের ক্ষেত্রে মাঢ়ি রোগের বিভিন্ন জটিলতা বেশি দেখা যায়। এক গবেষণায় দেখা গেছে ডায়াবেটিস নাই এমন ব্যক্তির চেয়ে ডায়াবেটিক রোগীর দাঁত হারানোর সম্ভাবনা প্রায় পাঁচগুণ বেশি।

ডায়াবেটিক রোগীদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকায় জীবাণু সংক্রমণ দ্রুত বিস্তার লাভ করে। এসব কারণে মাড়ি রোগ সৃষ্টি হলে সেখানে পেরিওডন্টাল পকেট সৃষ্টি হয়। তারপর ধীরে ধীরে পেরিওডন্টাল পকেটে খাদ্য দ্রব্য জমা হয়ে মাড়ি ফুলে যেতে পারে। সেখান থেকে নানা ধরণের জটিলতা দেখা দিতে পারে। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে না রাখলে পেরিওডন্টাল লিগামেন্টগুলো দুর্বল হয়ে পড়ে এবং এক সময় দেখা যায় দাঁত নড়তে শুরু করে। যাদের মাঢ়ি বা পেরিওডন্টাল রোগ থাকে তাদের ক্ষেত্রে হৃদরোগ হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। পেরিওডন্টাল রোগের কারণে লিভারের সমস্যাও দেখা দিতে পারে।

ডায়াবেটিস রোগীর মুখে শুকনো ভাব থাকে। মাঝে মাঝে স্যালাইভারি গ্ল্যান্ড বা লালাগ্রন্থি ফুলে যেতে পারে যা সায়ালোসিস নামে পরিচিত। এটি সাধারণত স্বয়ংক্রিয় নিউরোপ্যাথির কারণে হতে পারে। জিহ্বার প্রদাহ দেখা যেতে পারে বা জিহ্বার ফিলিফরম প্যাপিলার পরিবর্তন আসতে পারে। ফলে খাবারের স্বাদ গ্রহণে সমস্যা হতে পারে। খাদ্যদ্রব্য গ্রহণ করার সময় জিহ্বায় অনেক সময় ঝাল ঝাল অনুভব হতে পারে। ক্লোরপ্রোপামাইড ব্যবহারের কারণে মুখের মিউকোসাতে লাইকেনয়েড রিঅ্যাকশন দেখা যেতে পারে। অন্যান্য এন্টিবায়োটিক ওষুধের কারণেও এমনটি হতে পারে। ক্লোরপ্রোপামাইডের কারণে ফেসিয়াল ফ্লাসিং হতে পারে। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ যদি দূর্বল হয় তাহলে ওরাল ক্যান্ডিডোসিস এর সৃস্টি হতে পারে।

ডায়াবেটিস ইনসিপিডাস এর ক্ষেত্রে দন্তচিকিৎসা বিদ্যায় সাধারণত তেমন সমস্যা হয় না মুখের শুষ্কতা ছাড়া। ক্ষণস্থায়ী ডায়াবেটিস ইনসিপিডাস হেড ইনজুরির জটিলতা হিসাবে দেখা যায়। কার্বামাজেপেইন ওষুধ যা ব্যবহার করা হয় ট্রাইজেমিনাল নিউরালজিয়াতে সেটির নেশাকারী কার্যকারিতা থাকতে পারে ডায়াবেটিস ইনসিপিডাস চিকিৎসায় ব্যবহৃত অন্যান্য ওষুধের সঙ্গে। টাইপ-২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মানুষদের চিন্তা ও স্মৃতিশক্তিজণিত কার্যক্রমে অধিক সমস্যা হয়ে থাকে। টাইপ-১ ডায়াবেটিস একটি অটোইমমিউন রোগ যা প্যানক্রিয়াস বা অগ্ন্যাশয়ের সেল বা কোষকে ধ্বংস এবং নষ্ট করে থাকে।

যাদের ডায়াবেটিস আছে তাদের ক্ষেত্রে ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথি এবং পেরিফেরাল ভাসকুলার ডিজিজ পা ক্ষতিগ্রস্থ করতে পারে। তাই ডায়াবেটিস হলে পায়ের আলাদা যতœ নিতে হবে। যারা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত তাদের ক্ষেত্রে ব্যথামুক্ত হার্ট এ্যাটাক বা সাইলেন্ট হার্ট এ্যাটাক দেখা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে ডায়াবেটিস আক্রান্ত কারো হার্ট ্এ্যাটাক হলে রোগী কোনো ব্যথা অনুভব করবে না। ফলে আশেপাশের কেউ বুঝতেও পারবে না যে, পাশের মানুষটির হার্ট এ্যাটাক হয়েছে। ফলে বিনা চিকিৎসায় আক্রান্ত ব্যক্তির মৃত্যু হতে পারে। অতএব, ডায়াবেটিস রোগীদের সব সময় সতর্ক থাকতে হবে।

ডায়াবেটিক রোগীদের ক্ষেত্রে মাড়ি রোগে সামান্য আঘাতে মাঢ়ি থেকে রক্তক্ষরণ হয়। মাঢ়ি স্পঞ্জের মতো নরম তুলতুলে হয়ে যায়। দাঁত নড়ে যেতে পারে। দাঁত শিরশির করা ছাড়াও মাড়ি থেকে পুঁজ বের হতে পারে। মুখে দুর্গন্ধ সৃষ্টি হওয়া ছাড়াও খাবার গ্রহণের সময় দাঁতে ব্যথা অনুভুত হতে পারে। ডায়াবেটিস হলে কোনোভাবেই মাঢ়ির রোগকে অবহেলা করা যাবে না।

আপনার দাঁতে যদি পাথর থাকে তাহেল অবশ্যই স্কেলিং করিয়ে নিতে হবে। তাছাড়া নিয়মিত দাঁত ব্রাশ করা ছাড়া মাঝে মাঝে মাউথওয়াশ ব্যবহার করতে হবে। তবে সঠিক মাউথওয়াশ ব্যবহার না করলে অনেক সময় মুখে আলসার বা ঘাঁ থাকলে তা সহজে ভালো হয় না। ডায়াবেটিসের কারণে মুখের বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা পদ্ধতি ভিন্œ হয়ে থাকে। ডায়াবেটিক রোগীদের ক্ষেত্রে ঔষধ সাবধানে প্রয়োগ করতে হবে। ডায়াবেটিক রোগীর মুখের অভ্যন্তরে কোনো আলসার দেখা দিলে কোনো ভাবেই অবহেলা করা ঠিক নয়। ডায়াবেটিসের কারণে শুষ্ক মুখ হলে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে দন্তক্ষয় অনেক বেশি হয়ে থাকে। তাই পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করতে হবে। সর্বোপরি যাদের ডায়াবেটিস রয়েছে তাদের নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্যে জীবন-যাপন করতে হবে।

ডাঃ মোঃ ফারুক হোসেন,
মুখ ও দন্তরোগ বিশেষজ্ঞ

About Post Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *