দেশের স্বাস্থ্য খাতে বিশেষ নজর দেওয়া দরকার

স্বাস্থ্যসেবা মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলোর অন্যতম। সেকারণেই বিশ্বের প্রায় সব দেশ মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার জন্য সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়।

এসডিজি’র ১৭টি লক্ষ্যের ‘সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা’ প্রধানতম। তা সত্তে¡ও দেশের স্বাস্থ্য খাতের সার্বিক পরিস্থিতি করুণ। বিবিএস রিপোর্ট-২০১৭ অনুযায়ী, ‘দেশের ৫৭% মানুষ স্বাস্থ্য সেবার বাইরে রয়েছে।’ তারা তাবিজ, পানি পড়া, ঝাঁর-ফুক ও কবিরাজি ইত্যাদি অপচিকিৎসা নির্ভর। ফলে তারা ব্যাধি মুক্ত হয় না। চরম কষ্টে ভোগে। অনেকের অকাল মৃত্যু ঘটে। এভাবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও পরিবার এবং দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই শ্রেণির মানুষ গরিব ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন। অবশিষ্ট ৪৩% মানুষের প্রায় অর্ধেক অসচেতনতা ও অভাবের কারণে চিকিৎসকের কাছে না গিয়ে ওষুধ বিক্রেতার কাছে গিয়ে অসুখের বর্ণনা দেয়। তার ভিত্তিতে বেশিরভাগ দোকানী মনগড়াভাবে অনেক হাই পাওয়ারের ও অপ্রয়োজনীয় ওষুধ দেয়। এতে হিতে বিপরীত হয় অনেকের।

বিশেষজ্ঞদের অভিমত, দেশের যেখানে সেখানে গড়ে উঠেছে ওষুধের দোকান। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের চা-পান-বিড়ি, মুদির দোকানেও বিক্রি হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের ওষুধ। আর ফার্মেসি ওষুধ বিক্রেতাদের বেশিরভাগেরই নেই প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও শিক্ষা। রাজধানীতেও এ সংখ্যা কম নয়। অবৈধ ওষুধের দোকান জনস্বাস্থ্যের জন্য বড় হুমকি। তবুও প্রায় ৭০% ওষুধের দোকানই চলছে অনুমোদনহীনভাবে। বাকী ২০-২৫% মানুষ ডাক্তারের কাছে যায়। কিন্তু তাতেও বিপত্তির অনেক। কারণ, স্বাস্থ্য সেবা অপ্রতুল।

দেশে স্বাস্থ্য খাতের অবকাঠামো ভাল। কিন্তু ডাক্তার, নার্স ও অন্যান্য জনবল এবং মেশিনপত্র, ওষুধ ইত্যাদির ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। এসডিজি’র মানদন্ড অনুযায়ী প্রতি ১০ হাজার মানুষের জন্য চিকিৎসক, নার্স ও ধাত্রীর অনুপাত ৪৪.৫। কিন্তু বাংলাদেশে তার অনুপাত মাত্র ৭.৪। আর প্রতি দুজন নিবন্ধিত চিকিৎসকের বিপরীতে নার্স রয়েছে একজন। অথচ হু’র মতে, একজন নিবন্ধিত চিকিৎসকের বিপরীতে তিনজন প্রশিক্ষিত নার্স থাকার কথা। সর্বোপরি ডাক্তার ও স্বাস্থ্য কর্মীদের কর্তব্যে অবহেলা তো রয়েছেই।

অভিযোগ আছে, উপজেলা পর্যায়ে বেশিরভাগ ডাক্তার থাকে না। এ ব্যাপারে কঠোরতা অবলম্বন করেও সুফল পাওয়া যায়নি। অন্যদিক, সরকারি বেশিরভাগ চিকিৎসা কেন্দ্রের মেশিনপত্রের অধিকাংশই নষ্ট হয়ে পড়ে থাকে। আবার কিছু মেশিন ভাল থাকলেও তা পরিচালনার লোক থাকে না। হাসপাতালের বেড সংখ্যা স্বল্প। চিকিৎসা ও টেস্ট রিপোর্টের মান খারাপ। বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকের সাথে যোগসাজশ রয়েছে অনেকের। ব্যাপক দুর্নীতিও আছে। ভুল ও অবহেলায় মৃত্যুর হার অনেক। এছাড়া, বেশি পাওয়ার ফুল ও অপ্রয়োজনীয় ওষুধ ও টেস্টের তো অন্ত নেই। দ্বিতীয়ত সরকারি স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোর বেশিরভাগের পরিবেশ অত্যন্ত নোংরা। নিরাপত্তারও প্রচন্ড অভাব রয়েছে।

সার্বিকভাবে সরকারি চিকিৎসা কেন্দ্রগুলোর চিকিৎসার মান ও পরিবেশ খারাপ। বেসরকারি খাতের চিকিৎসা সেবা কিছুটা ভালো। বেশিরভাগ চিকিৎসাও হয় সেখানে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ২০১৮ সালের হেলথ বুলেটিনের তথ্য মতে, ‘বাংলাদেশের ১,৪৩,৩৯৪ রেজিস্টার্ড হাসপাতাল শয্যার ৬৩% বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে অবস্থিত।’ কিন্তু বেসরকারি খাতের চিকিৎসা ব্যয় অত্যধিক, সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। এর মধ্যে অনেক কিছু অপ্রয়োজনীয়। শুধুমাত্র বাণিজ্যিক কারণেই করা হয়। বাংলাদেশ ম্যাটার্নাল মর্টালিটি সার্ভে রিপোর্ট-২০১৬ মতে, ‘বেসরকারি খাতে সংঘটিত ৮৩% প্রসবই সিজারিয়ান হচ্ছে, যেখানে সরকারি খাতে এই হার ৩৫% ও এনজিও ক্লিনিকগুলোতে ৩৯%। কারণ, সাধারণ প্রসবে গড়ে খরচ পড়ে ২,৪৭৯ টাকা, আর সিজারিয়ানে খরচ গড়ে ২১,১৮৫ টাকা। অর্থাৎ প্রায় সাড়ে ৮ গুণ বেশি। এটা বাণিজ্যিক লাভের জন্য মানুষের অর্থ ও জীবনকে জিম্মি করার শামিল।’ এই অবস্থার পরিবর্তন হয়নি এখনো।

অদক্ষতার কারণে সিজারিয়ানের সময় অনেক মা-শিশুর অঙ্গহানি হয়। অন্য অপারেশনের ক্ষেত্রেও প্রায় তাই। এসব নিয়ে রোগীর অভিভাবক ও হাসপাতালের লোকদের মধ্যে গোলমাল সৃষ্টির অন্ত নেই। অন্যদিকে,দেশে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের অভাব অত্যধিক। তাই বড় শহরের বাইরে তাদের পাওয়া দুস্কর। তাদের ভিজিট অনেক। এছাড়া, দেশের বেশিরভাগ হাসপাতাল স্বয়ংসম্পন্ন নয়। তাই একেকটি ব্যাপারে একেকটি হাসপাতালে যেতে হয়। ফলে রোগীর হয়রানি ও ব্যয় বেশি হয়। এছাড়া দেশে অনেক ভুয়া ক্লিনিক ও ডাক্তার আছে। যাদের অনেক সনাক্ত হয় প্রায়ই।

দেশে অসংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ক্রমশ: বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর তেমন চিকিৎসা নেই। যেটুকু আছে তার ব্যয় অত্যধিক। ১৭ অক্টোবর ক্লিনিকাল রিসার্চ প্ল্যাটফর্ম, বাংলাদেশ-এর সংবাদ সম্মেলনের তথ্য মতে, ‘দেশে পরিবারের মোট চিকিৎসার ৭১% খচর হচ্ছে অসংক্রামক রোগের পেছনে। অসংক্রামক রোগে মারা যাচ্ছে ৬৭% মানুষ। তন্মধ্যে ৩০% হৃদরোগে, ১২% ক্যানসারে, ১০% শ্বাসতন্ত্রের রোগে, ৩% ডায়াবেটিসে এবং ১২% অন্যান্য অসংক্রামক রোগে মারা যায়। হু’র ২০১৬ সালের তথ্য মতে, বাংলাদেশে অসংক্রামক রোগে ৫,৭২,৬০০ জন লোক মারা গেছেন।’ ইউনিসেফ’র গত ১২ নভেম্বর প্রকাশিত প্রতিবেদন মতে, ‘গত বছর বাংলাদেশে নিউমোনিয়া আক্রান্ত হয়ে পাঁচ বছরের কম বয়সী আনুমানিক ১২ হাজার শিশুর মৃত্যু হয়েছে।’ নিউমোনিয়ায় শিশু মৃত্যুহার বিশ্বে ১৪তম বাংলাদেশ। এ প্রসঙ্গে শিশুস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডাক্তার রওশন আরা বলেন, শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকার কারণে তাদের মধ্যে রোগসংক্রমন ও মৃত্যুর সংখ্যা বেশী হয়।

শিশুর পুষ্টিহীনতা ও পরিবেশজনিত দূষণের কারণে এ রোগের আক্রমণ বেশি হয়। মানসিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সর্বশেষ জাতীয় জরিপ মতে, দেশে প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের ১৭% ও অপ্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের ১৩.৬% মানসিক রোগী। কিন্তু ডাক্তারের সংখ্যা মাত্র আড়াইশ’ বলে গত ১৩ নভেম্বর এক দৈনিকে প্রকাশ। মাদকাসক্ত রোগীর সংখ্যাও অনেক। কিন্তু তেমন চিকিৎসা ব্যবস্থা নেই। ডায়াবেটিক রোগীর সংখ্যা প্রায় ৯০ লাখ, বছরে বাড়ছে আরও এক লাখ করে।

অথচ সারাদেশে সরকারি হাসপাতালগুলোর ৫০ হাজার শয্যার মধ্যে ডায়াবেটিস রোগীদের শয্যা রয়েছে মাত্র ১১০টি। বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের অভিমত, অন্ধত্ব, অঙ্গহানি, হৃদরোগ, কিডনি জটিলতা ও অকাল মৃত্যুও অন্যতম কারণ ডায়াবেটিস। সব বয়সের মানুষই এখন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছে।

দেশে মৃত্যুর সপ্তম প্রধান কারণ ডায়াবেটিস। ইউনিসেফ’র মতে, অপরিণত শিশুর জন্মের ক্ষেত্রে বিশ্বে বাংলাদেশ সপ্তম। বাংলাদেশে প্রতিবছর ৪,৪৬,৯০০ শিশু সময়ের আগেই জন্ম নেয়। তন্মধ্যে ২৩,৬০০ শিশু পাঁচ বছর বয়সের আগেই মারা যায়। এই অপরিণত শিশু জন্মের অন্যতম কারণ মায়ের পুষ্টি হীনতা ও অল্প বয়সে বিয়ে। এটি কমাতে, বাড়াতে হবে সচেতনতা আর নারীর ক্ষমতায়ন বলে জানা গেছে।

গত ১৪ নভেম্বর প্রকাশিত ল্যানসেট›র প্রতিবেদন মতে, ‘বাংলাদেশে ২০১০-২০১৪ সাল পর্যন্ত ডেঙ্গু ঝুঁকি প্রায় ৩৯% কমে ছিল; কিন্তু ২০১৪-২০১৭ সালের মধ্যে এই ঝুঁকি আবারও প্রায় ৩৬% বেড়েছে।’ ডেঙ্গু এখনো অব্যাহত আছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী গত ১৪ নভেম্বর সংসদে বলেন, ‘দেশে গত ৫ নভেম্বর থেকে এখন পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ৯৭,০০৯ জন। এতে মারা গেছেন ১২২ জন।’ এবার ডেঙ্গু নিয়ে দেশে মহা আতংক সৃষ্টি হয়েছিল। তদ্রæপ অবস্থা হয়েছিল চিকুনগুনিয়া নিয়ে কয়েক বছর আগে। এই অবস্থায় ইবোলা, প্লেগ ইত্যাদি নতুন ধরণের জটিল ব্যাধি নিয়ে জনমনে আশংকা রয়েছে। অথচ এখন চালু হয়েছে ৫-জির মাধ্যমে চিকিৎসা।

পনের শত মাইল দূরে থেকে ডাক্তাররা জটিল ব্যাধির অপারেশন করছেন ৫-জির মাধ্যমে। এই ব্যবস্থা স¤প্রতি চীনে চালু হয়েছে। এমনকি রোবটের মাধ্যমেও অপারেশন করা হচ্ছে ভারত ও অন্যান্য দেশে। রোগীর নানা উপসর্গ শনাক্ত ও পর্যবেক্ষণ করার রাডারও আবিষ্কার হয়েছে। এসব ব্যবস্থা এ দেশে এখনো কল্পনাতীত! এসর নানা কারণে সামর্থ্যবানরা দেশের বাইরে চিকিৎসা করায়। বছরে তাদের সংখ্যা প্রায় ৪ লাখ। এতে ব্যয় হচ্ছে বছরে ৪শ’ কোটি মার্কিন ডলারের অধিক।

দেশে ব্যক্তি খাতে চিকিৎসা ব্যয় মাত্রাতিরিক্ত। হু’র গাইডলাইন অনুসারে, একজন নাগরিক স্বাস্থ্যের জন্য ব্যয় করবে ৩২%। অবশিষ্ট অর্থ সরকার খরচ করবে। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ স্বাস্থ্য ব্যয়ের ৬৭% মিটিয়ে থাকে নিজে। অথচ নিজে ব্যয় করে নেপালে ৪৮%, শ্রীলঙ্কায় ৪২%, ভুটানে ২৫%, পাকিস্তানে ৫৬%। অবশিষ্ট ব্যয় আসে সরকারের পক্ষ থেকে। প্রতি বছর বাংলাদেশের ৫০ লাখ মানুষ স্বাস্থ্য ব্যয় মেটাতে গিয়ে দরিদ্র হচ্ছে। এছাড়া, দেশে স্বাস্থ্য বীমার অবস্থাও ভালো নয়।

এসডিজি অনুযায়ী, দেশের সব মানুষকে ২০৩০ সালের মধ্যে সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার আওতায় আনা বাধ্যতামূলক। সে জন্য ২০২১ সালের মধ্যে স্বাস্থ্য বীমার জন্য বাংলাদেশকে জিডিপির ৪% ব্যয় করতে হবে। কিন্তু এ সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ স্বাস্থ্য বীমায় ব্যয় করছে মাত্র ০.০৯%। অথচ এই ব্যয় ভারতে ৩.০৭%, মালদ্বীপে ৪.৭০%, দক্ষিণ কোরিয়ায় ১২.৪৮%।

দেশের মেডিকেল শিক্ষার মান অত্যন্ত দুর্বল। এর একটি প্রমাণ বিদেশ থেকে এমবিবিএস ডিগ্রি গ্রহণ করা ভারতীয় নাগরিকদের দেশে প্র্যাকটিসের লাইসেন্স পেতে ফরেন মেডিকেল গ্র্যাজুয়েট এক্সামিনেশনে পাস করার শর্ত রয়েছে, যার পরীক্ষা হয় জাতীয় পরীক্ষা বোর্ডের অধীনে। বোর্ডের সর্বশেষ প্রতিবেদন মতে, এফএমজিই টেস্টে অংশ নেয়া পরীক্ষার্থীদের উল্লেখযোগ্য অংশই বাংলাদেশের বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ থেকে পাস করা এবং এদের ৭২% এ পরীক্ষায় ফেল করেছে। এভাবে যদি ইউরোপ-আমেরিকায় পরীক্ষা হয়, তাহলে ভারতের চেয়েও রেজাল্ট খারাপ হবে তা নিশ্চিত।

দেশ ওষুধ উৎপাদনে প্রায় স্বয়ংসম্পন্ন হয়েছে। চাহিদার প্রায় ৯৭% উৎপাদন হচ্ছে। উপরন্তু বহু দেশে রফতানি হচ্ছে বিপুল অংকের ওষুধ। কিন্তু দেশের অভ্যন্তরে বাজারজাতকৃত অনেক ওষুধের মান খারাপ। সর্বত্র মানহীন, নকল, ভেজাল ও মেয়াদ উত্তীর্ণ ওষুধের ছড়াছড়ি। মূল্যও অধিক। ওষুধ উৎপাদনের কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক-কর ছাড়সহ নানা প্রণোদনা দেওয়ার পরও সুফল পাচ্ছে না ভোক্তারা। এসব থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য জাতীয় ওষুধ নীতি-২০১৭ প্রণয়ন করা হয়েছে। কিন্তু তা ভালভাবে কার্যকর হয়নি। এমনকি ‘মডেল ফার্মেসি’ও প্রতিষ্ঠা করা হয়নি তেমন। অথচ প্রতিটি হাসপাতালে এটা করতে বাধ্য করা হলে তা এতদিনে হয়ে যেত। মানুষের কল্যাণ হতো।

মানহীন ওষুধের কারণে মানুষের নানা ব্যাধি হচ্ছে। এই অবস্থায় মরার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দেখা দিয়েছে ইয়াবা। দেশের কয়েকটি নামিদামি ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের তৈরি বেশ কিছু ওষুধে ইয়াবার উপাদান- অ্যামফিটামিন থাকার অভিযোগ উঠেছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কোনো কোনো ওষুধ কোম্পানির ওষুধে ইয়াবার উপাদান থাকার প্রমাণ পেয়েছে ল্যাব টেস্টের মাধ্যমে। বিষয়টি সরকারের ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের নজরে থাকলেও এখন পর্যন্ত এসব ওষুধ বন্ধ বা নিষিদ্ধ করা কিংবা ওই সব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

দেশে ওষুধ উৎপাদনের কাঁচামাল আমদানি করতে হয় চাহিদার ৯৭%। এতে ওষুধের মূল্য বেশি হয়। মোট কথা, দেশের সার্বিক স্বাস্থ্য পরিস্থিতি শোচনীয়। তাই বৈশ্বিক স্বাস্থ্য সূচকে দেশের অবস্থান নিচে। এর প্রধান কারণ, পরিচালনায় দক্ষতার অভাব ও সরকারি ব্যয়ের হার খুব কম।

স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল। তাই সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করা আবশ্যক। সে লক্ষ্যে অবিলম্বে সরকারি স্বাস্থ্য কেন্দ্রে অনুমোদিত পদসমূহ পূরণ, প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি ও ওষুধ সরবরাহ, সব রকমের দুর্নীতি, অনিয়ম, অপচয় ও স্বজনপ্রীতি রোধ এবং প্রত্যেকের জবাবদিহি প্রতিষ্ঠা, সব জনবলের নিয়মিত উন্নতর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা আবশ্যক। এছাড়া, সাবেক চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে পূরণ, সব জনবলের আগমন ও নির্গমনের সময় ফিঙ্গার প্রিন্ট চালু এবং সর্বত্রই সিসি ক্যামেরা স্থাপন ও মনিটর করে তার ভিত্তিতে ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার। এসব হলে অর্ধেক সমস্যা দূর হয়ে যাবে। বেসরকারি হাসপাতালে এসব করে ভালো সুফল পাওয়া গেছে। এছাড়া, বেসরকারি

চিকিৎসা খাতকে পূর্ণ নিয়মের মধ্যে আনা প্রয়োজন। চিকিৎসায় সর্বাধুনিক প্রযুক্তি, ব্যাধি ও ওষুধ যুক্ত করে মেডিকেল শিক্ষা আধুনিকায়ন ও শিক্ষার মানোন্নয়ন এবং উন্নত মানের গবেষণা ও আধুনিক চিকিৎসা প্রবর্তন করা প্রয়োজন। এছাড়া, প্রয়োজনীয় বিশেষজ্ঞ ডাক্তার তৈরি করা দরকার। এছাড়া, প্রত্যেক হাসপাতালকে স্বয়ংসম্পন্ন তথা এক ছাদের নিচেই সব রোগের চিকিৎসা দেওয়ার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। তাহলে বিভিন্ন রোগের কারণে রোগীদের নানা হাসপাতালে দৌড়াতে হবে না। মানুষ হয়রানি ও অতিরিক্ত ব্যয় থেকে রক্ষা পাবে। এ ধরনের ব্যবস্থা বহু দেশে আছে। সর্বোপরি ডাক্তারদের পদোন্নতি ও পোস্টিং বৈষম্য দূর করা প্রয়োজন। কারণ, এটা না হলে ডাক্তারদের মধ্যে সৃষ্ট ক্ষোভ দূর হবে না, ভালো সেবা পাওয়া যাবে না।

রোগের উৎসস্থল নির্মূল করা অপরিহার্য। যেমন: সব রকমের দূষণ, অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ, ভেজাল, অপচিকিৎসা, মাদক, বাল্য বিবাহ, দুর্ঘটনা ও অপুষ্টি নির্মূল এবং ওষুধ নীতি-২০১৭ কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা দরকার। প্রস্তাবিত স্বাস্থ্যসেবা ও সুরক্ষা আইন-২০১৮ নিয়ে ডাক্তারদের কিছু পরামর্শ রয়েছে। পরামর্শগুলোর মধ্যে যেগুলো গুরুত্বপূর্ণ সেগুলো গ্রহণ করে দ্রæত বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা বাস্তবায়নের জন্য স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় বৃদ্ধি করে কমপক্ষে জিডিপি’র ৬% করা আবশ্যক। বলা বাহুল্য, চিকিৎসা সেবা একটি মানবিক কর্ম। অন্য পেশার মতো নয়-এটা সেবামূলক পেশা। এই মনোবৃত্তি নিয়ে কাজ করা উচিৎ স্বাস্থ্য খাতের সকলের।

মনে রাখা উচিৎ, তাদের কর্মের সাথে মানুষের মরা-বাঁচার বিষয় জড়িত। বিশ্বে স্বাস্থ্য খাতে নিত্য নতুন আবিষ্কার ও প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও সংযুক্ত হচ্ছে, যা বিপ্লব সাধন করছে। তাই সেদিকে দৃষ্টি রাখা এবং তা দেশে প্রয়োগ করা দরকার। নতুবা রোগীরা বিদেশে চলে যাবে আধুনিক চিকিৎসা গ্রহণের জন্য।

দেশে উৎপাদিত ওষুধের কাঁচামাল আমদানি নির্ভর। ফলে ওষুধের মূল্য বেশি হয়। এই অবস্থায় দেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হলে এলডিসিভুক্ত দেশ হিসাবে যে প্যাটেন্ট সুবিধা পাচ্ছে, তা থাকবে না। তখন ওষুধের মূল্য কয়েকগুণ বেড়ে যাবে। যা সাধারণ মানুষের পক্ষে নির্বাহ করা কঠিন হবে। দ্বিতীয়ত ওষুধ উৎপাদনের ব্যবসা খুব লাভজনক। তাই প্রয়োজনীয় কাঁচামালের উৎপাদনের ব্যবস্থা দেশেই করতে হবে। এর বাজারও স¤প্রসারিত করতে হবে দেশ-বিদেশে।

স্বাস্থ্যের ব্যাপারে মানুষকেও সচেতন হতে হবে। সব কিছু সরকার করে দেবে সে আশায় বসে থাকলে স্বাস্থ্য রক্ষা হবে না। তাই নিজের কাজ নিজেকেই করতে হবে। সে জন্য নিয়মিত ও পরিমিত আহার, ঘুম, ব্যায়াম, খেলা-ধূলা, বিনোদন, সুষম খাবার গ্রহণ করা দরকার। বাসি-পচা, খোলা খাবার ও তামাকজাত পণ্য, দুঃশ্চিন্তা, ইন্টারনেট আসক্তি, প্রসাধনী ব্যবহার ইত্যাদি ত্যাগ করা আবশ্যক।

বেশি করে দুধ, ডিম, শাক-সব্জি ও ফল খাওয়া, সব সময় শরীর, পোশাক ও দাঁত পরিষ্কার রাখা, বাথরুম ব্যবহারের পর ও খাবারের আগে সাবান দিয়ে হাত পরিষ্কার করা এবং ভোজ্য তেল, তৈলাক্ত মাংস ও মসল্লা কম খাওয়া প্রয়োজন। সর্বোপরি যে কোনো ব্যাধি নিরাময়ের জন্য রেজিস্টার্ড ডাক্তারের কাছে যাওয়া প্রয়োজন। অন্য কোনো পথে নয়। দেশের প্রখ্যাত এক অধ্যাপক ডাক্তারের অভিমত হচ্ছে: ‘প্রতিদিন নিয়মিত হাঁটলে অর্ধেক অসুখ এমনিতেই ভালো হয়ে যায়।’ হ্যোমিও এবং আয়ুর্বেদীয় চিকিৎসাও কল্যাণকর এবং তা স্বল্প ব্যয়ী। চীনের চিকিৎসার বেশিরভাগই ভেষজ নির্ভর। ভারতে হ্যোমিও পদ্ধতির হাসপাতাল আছে। যা’হোক, স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া না হলে উন্নতির সব ফায়দা খেয়ে ফেলবে ব্যাধি। সূত্র ইনকিলাব

About Post Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *