বাড়িতেই সন্তান প্রসব করেন ৮০ শতাংশের বেশি প্রসূতি

ন্যূনতম স্যানিটেশন সুবিধা নেই। অনুপস্থিত প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা। পুষ্টির বিষয়টি প্রায় অচেনা। অপুষ্টি তাই নিত্যসঙ্গী চা শ্রমিকদের পরিবারে।

সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জের ডালুছড়া চা বাগানের শ্রমিক সুমিতা কৈরি মা হন গত বছর। প্রশিক্ষিত ধাত্রী ছাড়াই নিজ বাড়িতেই প্রথম সন্তান জন্ম দেন তিনি। সিলেট শহরের পাশেই লাক্কাতুরা চা বাগানে শ্রমিক লক্ষ্মী গোয়ালা মাস দুয়েক আগে বাড়িতে সন্তান জন্ম দেন। প্রসবকালে প্রশিক্ষিত কোনো ধাত্রীর সহযোগিতা নেননি তিনিও।

সুমিতা কৈরির ভাষ্য, আমাদের পরিবারের সব নারীর বাড়িতে প্রসব হয়েছে। হাসপাতালে যাওয়া বাড়ির বয়স্করা পছন্দ করেন না। হাসপাতালে গেলে বা ধাত্রী ডেকে আনলে প্রসবকালীন ঝামেলা আরো বাড়ে।

লক্ষ্মী গোয়ালা অবশ্য বলেন অর্থ সংকটের কথা। তিনি বলেন, ডাক্তারের কাছে গেলে তো টাকা দিতে হয়। ধাত্রী আনতেও টাকা দিতে হয়। টাকা পাব কোথায়?

সুমিতা ও লক্ষ্মী গোয়ালা চাইলেই প্রশিক্ষিত ধাত্রী বা মিডওয়াইফের সেবা নিতে পারতেন। কিন্তু সে সুযোগটিও ছিল না বড়লেখার কেরামতনগর চা বাগানের শ্রমিক আয়েশা, সুদীপা ও অরুণার। তাদের বাগানে নেই প্রশিক্ষিত ধাত্রী বা মিডওয়াইফ। ফলে বাড়িতে প্রবীণ নারীদের সহযোগিতায় সন্তান প্রসব করেন তারা।

চা বাগানের প্রায় প্রতিটি ঘরে গেলেই শোনা যাবে এমন ঘটনা। বাগানের বেশির ভাগ নারীরই সন্তান প্রসব হয় নিজ বাড়িতে চিকিৎসক, মিডওয়াইফ বা প্রশিক্ষিত কোনো ধাত্রীর সহযোগিতা ছাড়াই।

চা শ্রমিকদের নিয়ে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, সিলেটের তিন জেলার চা বাগানগুলোর প্রসূতিদের ১৬ শতাংশ সরকারি-বেসরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যান। বাকি ৮০ শতাংশের বেশি নারী বাড়িতেই সন্তান জন্ম দেন। যদিও জাতীয়ভাবে ৫৩ দশমিক ৪ শতাংশ প্রসূতি সরকারি-বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে সন্তান জন্ম দেন। তবে সিলেট বিভাগে এ হার ৪০ দশমিক ২ শতাংশ। এ বিভাগের চা বাগানগুলোয় তা আরো কম।

সিলেট বিভাগীয় পরিচালকের (স্বাস্থ্য) দপ্তরের সহকারী পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) ডা. মো. আনিসুর রহমান বলেন, বেশির ভাগ চা বাগানেই প্রশিক্ষিত ধাত্রী বা মিডওয়াইফ নেই। এলাকার বয়স্ক নারীরাই এ কাজ করে থাকেন। ফলে চা বাগানগুলোতে মাতৃ ও নবজাতক মৃত্যুর হারও বেশি। চা বাগানের এক হাজার নবজাতকের মধ্যে ৫৫টি জন্মের সময়ই মারা যায়। সিলেট বিভাগে এ সংখ্যা ২৮।

তবে বাড়িতেই সন্তান প্রসবেরও কিছু ভালো দিক দেখছেন বর্তমানে সিলেটে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করা বালিশিরা চা বাগানের বাসিন্দা অনিল পাল। তিনি বলেন, বাড়িতে প্রসব হওয়ায় চা বাগানে শিশুজন্মে অস্ত্রোপচারের হার খুব কম।

অনিলের এমন দাবির সত্যতা মিলেছে জরিপের তথ্যেও। বিবিএসের জরিপে দেখা গেছে, চা বাগানে সন্তান প্রসবকালে অস্ত্রোপচারের হার মাত্র ৫ মাত্র ৬ শতাংশ। যদিও এ হার সারা দেশে ৩৬ শতাংশ আর সিলেট বিভাগে ১৯ দশমিক ৭ শতাংশ।

তবে অনিলের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করেন মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে চা শ্রমিকদের জন্য বালিশিরা টি কোম্পানি পরিচালিত ক্যামিলিয়া হাসপাতালের সেবিকা সানজানা শিরিন। তিনি বলেন, বাড়িতে কোনো প্রশিক্ষিত ধাত্রী ছাড়াই সন্তান প্রসব করায় প্রসূতি ও নবজাতকরা অনেক সমস্যায় ভোগেন। অতিরিক্ত রক্তপাত ও সংক্রমণের সমস্যা দেখা দেয়। সানজানা বলেন, শহরের পার্শ্ববর্তী বাগানগুলোয় প্রশিক্ষিত ধাত্রী থাকলেও প্রত্যন্ত এলাকার বাগানে এ রকম কাউকে পাওয়া যায় না।

জানা যায়, ২০০৭-০৮ সালে সিলেটের বিভিন্ন চা বাগানের কয়েকজন নারীকে মিডওয়াইফ হিসেবে প্রশিক্ষণ প্রদান করে ‘মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন’ নামে একটি উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা। তবে প্রশিক্ষণের পর দু-একজন ছাড়া কোনো প্রশিক্ষণার্থী এটিকে পেশা হিসেবে নেননি।

‘মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন’-এর মাধ্যমে মিডওয়াইফের প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন লাক্কাতুরা চা বাগানের পরশ গোয়ালা। তিনি এখনো এ পেশায় আছেন। পরশ বলেন, দারিদ্র্য, কুসংস্কার, অশিক্ষাসহ নানা কারণে চা বাগানের নারীরা প্রসবকালে মিডওয়াইফ ডাকেন না। বাগানে এটি পেশা হিসেবে নেয়া মোটেই লাভজনক নয়।

পুরনো ধ্যানধারণা আর কুসংস্কারের কারণেই চা বাগানের অনেক নারী প্রশিক্ষিত ধাত্রীর সেবা নেন না বলে জানিয়েছেন সিলেটের শ্রীপুর চা বাগানের ব্যবস্থাপক মনসুর আহমদও। তিনি বলেন, এখন প্রায় প্রত্যেক বাগানেই মিডওয়াইফ আছেন। তবু অনেকে এ সেবা গ্রহণ করেন না।

ইউনিসেফের সহায়তায় প্রথমবারের মতো পরিচালিত এ জরিপ অনুযায়ী, ১৮ বছরের আগেই মা হন চা বাগানের ২২ দশমিক ২ শতাংশ নারী। শিশু জন্মের দুই দিনের মধ্যে বাসা বা হাসপাতালে স্বাস্থ্যসেবা নিয়েছেন এমন নারীর হার ৪৩ শতাংশ। সূত্র বণিক বার্তা

About Post Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *