স্বাস্থ্যসম্মত পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা

নানা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের জরিপে দেখা যায়, বিশ্বের ৪০ শতাংশ মানুষ এখনো স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা সুবিধার বাইরে। শুধু ঢাকা শহরে প্রতিদিন ৬৫ লাখ ভাসমান মানুষ উন্মুক্ত স্থানে মলমূত্র ত্যাগ করছে। ছয় থেকে ১০ লাখ মানুষ প্রতিদিন নৈমিত্তিক কাজে ঢাকায় যাওয়া-আসা করলেও তাদের জন্য সঠিক টয়লেট ব্যবস্থা নেই।

সারা বিশ্বে স্যানিটেশন কার্যক্রমকে শতভাগ সঠিক ব্যবস্থাপনায় আনতে সচেতনতা সৃষ্টির ওপর বিশেষ জোর দেয়া হয়েছে। চালু হয়েছে ‘বিশ্ব টয়লেট দিবস’। ওয়ার্ল্ড টয়লেট অর্গানাইজেশনের শ্রম-ঘাম, মেধা-বুদ্ধি আর জোরালো দাবির ফসল, এই দিবস। ১৯ নভেম্বর ২০০১ সাল থেকে টয়লেটকে উপজীব্য করে বিশ্বব্যাপী পালন করা হচ্ছে দিনটি।

জাতিসঙ্ঘের সর্তকবার্তা হচ্ছে, কোনো মানুষ যেন বনবাদাড়ে, নদী-খালে, পথঘাটে, রাস্তার পাশে শৌচকর্ম না করে। বিশ্বের প্রায় ১০০ কোটি মানুষের জন্য উন্নত শৌচাগারের ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়নি আজো। খোলা জায়গাকে শৌচাগার বানানোর ক্ষেত্রে সবচেয়ে এগিয়ে আছে ভারত। এরপরই রয়েছে ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান, নেপাল ও চীন। আফ্রিকা খুব পিছিয়ে নেই এ ক্ষেত্রে। তাদের অধিক জনসংখ্যার দেশ নাইজেরিয়াই সবচেয়ে এগিয়ে। তাদের বেশির ভাগ মানুষ পায়খানা-প্রস্রাবের সময় খোলা আকাশকে বেছে নেয়। এ কারণে সর্বত্র অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ সৃষ্টি হয়। শুধু টয়লেটের অপ্রতুলতার কারণে সারা বিশ্বে প্রতি আড়াই মিনিটে একজন শিশুর মৃত্যু ঘটে। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যকর শৌচাগার না থাকায় শিশুশিক্ষা ও নারীশিক্ষার ব্যাঘাত ঘটছে। সন্তানকে স্কুলে পাঠানো থেকে বিরত থাকছেন অনেকে। ঘরের বাইরে প্রাকৃতিক কাজ সারতে গিয়ে দুর্ঘটনা, ধর্ষণ, লাঞ্ছনার শিকার হওয়া নারীর সংখ্যা আমাদের দেশে কম নয়।

শৌচাগার ও পয়ঃনিষ্কাশন অপরিহার্য হলেও অনেক ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ এমনকি দেশও তেমন ভ্রুক্ষেপ করে না এ বিষয়ে। আমাদের দেশেও পরিষ্কার পয়ঃপ্রণালী ব্যবস্থা নেই বিশেষ করে শহরের ঘুপচি, ঘিঞ্জি, কলকোলাহলপূর্ণ এলাকা, মার্কেট, স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়েও। দেখা যায়, উপচে পড়ছে উচ্ছিষ্ট ময়লা-আবর্জনা, নোংরা, জীবাণুর স্তূপ। পানি আছে তো বদনা নেই; বদনা থাকলেও খাঁ খাঁ শুকনো। পায়খানা-প্রস্রাবে দীর্ঘ অপেক্ষার সুযোগ থাকে না। কারণ তা স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকারক। বিশেষ করে নারী ও শিশুদের জন্য বিপজ্জনক। এই দৃশ্য আমরা হরহামেশা দেখে আসছি।

পরিবেশবান্ধব, সাশ্রয়ী ও নিরাপদ টয়লেট ব্যবস্থা গড়ে তুলতে গবেষণা কম হয়নি। দুর্গম, ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার জন্য উড়ন্ত শৌচাগার প্রকল্পও চালু করা হয়েছে। সহজে পরিবহনযোগ্য শৌচাগার ব্যবস্থা সভা-সমাবেশ জনবহুল স্থানে দেখা যায়। অনেক ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান টয়লেট রেস্তোরাঁ, টয়লেটের কমোড, বেসিন আকৃতির আসবাবপত্র, পড়ার টেবিল, চেয়ার, টয়লেট আকৃতির গাড়ি এখন বাজারজাত করছে। টয়লেট পরিচ্ছন্ন রাখার নানা রাসায়নিক আবিষ্কার, বাজারজাত করার বিশাল অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। ধর্মীয় দিক থেকে টয়লেট ব্যবহার প্রণালীর নিরাপদ অনুভূতি জাগাতে দোয়া-দরুদ, বেদমন্ত্র, আদেশ-নির্দেশনা রয়েছে।

পর্যাপ্ত টয়লেট স্থাপন এবং যেখানে শৌচালয় আছে তা যথাযথ পরিষ্কার রাখা আমাদের দায়িত্ব। টয়লেটের ব্যবহারবিধি পালন করা জরুরি। সেখানে হাত-পা ধোয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। বাড়ির ভেতরে ল্যাট্রিন হলে ভিন্ন কথা। অপচয় যেন না হয় সেদিকে খেয়াল থাকা উচিত। অবশ্যই জীবাণুনাশক সাবান, সোডা কিংবা ছাই দিয়ে হাত ভালোভাবে ধুয়ে নিতে হবে। অনেকে টয়লেটে বসে ধূমপান করে, এই বদ-অভ্যাস পরিত্যাগ করতে হবে।

পৃথিবীব্যাপী টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) নির্ধারণ করা হয়েছে। ২০৩০ সালের মধ্যে সবার জন্য সর্বত্র ও পর্যাপ্ত টয়লেট গড়ে তোলার অঙ্গীকারনামায় স্বাক্ষর করা হয়েছে। বাংলাদেশও এখানে অনুস্বাক্ষরকারী দেশ। সবখানে স্বাস্থ্যসম্মত নিরাপদ পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা পূরণের একটা বড় চ্যালেঞ্জ। দিবস পালনের মধ্য দিয়ে পয়ঃব্যবস্থাপনার শক্তিশালী অর্থনীতি, স্বাস্থ্যের উন্নতি, সামাজিক নিরাপত্তা, নারীর মর্যাদার উন্নতি ঘটবে। সুনির্দিষ্ট এই লক্ষ্যে কাজ হোক নিরন্তর। সূত্র নয়া দিগন্ত

About Post Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *