ডায়াবেটিস সম্পর্কে জানুন, রোগটি নিয়ন্ত্রণে রাখুন

ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনায় বিদ্যমান সমস্যা ও সীমাবদ্ধতাগুলোর প্রতি বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ এবং সব সরকার ও জনগণের তরফে সংহত ও সমন্বিত কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণে ঐকমত্য সৃষ্টির উদ্দেশ্যেই বাংলাদেশ ২০০৬ সালে জাতিসংঘকে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণকল্পে প্রস্তাব গ্রহণের আহ্বান জানায়। মূলত বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির আহ্বানে বাংলাদেশ সরকারের আনুষ্ঠানিক প্রস্তাবে এবং যৌক্তিক প্রচারণার প্রয়াসে ১৪ নভেম্বরকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস হিসেবে ঘোষণা দিয়ে জাতিসংঘ ২০০৭ সালে ৬১/২২৫ নম্বর প্রস্তাব গ্রহণ করে। সেই থেকে জাতিসংঘের সব সদস্য দেশে, বিশ্ব ডায়াবেটিক ফেডারেশনের দুই শর অধিক সদস্য সংগঠনে, বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য সংস্থা, কম্পানি, পেশাজীবী সংগঠন ও ডায়াবেটিক রোগীদের মাঝে বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস নানা প্রাসঙ্গিক প্রতিপাদ্য বিষয় নিয়ে উদ্যাপিত হচ্ছে। প্রসংগত যে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখার ক্ষেত্রে ১৯২১ সালে ফ্রেডরিক ব্যান্টিং এবং চার্লস বেস্ট কর্তৃক ইনসুলিনের আবিষ্কার এক যুগান্তকারী অগ্রগতি। এ জন্য ব্যান্টিং চিকিৎসায় নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন ১৯২৩ সালে। বলা বাহুল্য, ১৪ নভেম্বর ফ্রেডরিক ব্যান্টিংয়ের জন্মদিনকেই তাঁর প্রতি সর্বোচ্চ সম্মান প্রদর্শনার্থে বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস হিসেবে গৃহীত হয়েছে।

২০০৭ সালেই জাতিসংঘের গৃহীত প্রস্তাবের সঙ্গে সঙ্গে (ব্লু) নীল সার্কেল লোগোটিও নির্বাচিত হয়। নীল বৃত্ত জীবন ও স্বাস্থ্যের ধনাত্মক প্রতীক, নীলাকাশ সব জাতিনিচয়কে সংঘবদ্ধ করেছে এবং এ কারণে জাতিসংঘের পতাকার রংও নীল। নীল বৃত্ত বিশ্বব্যাপী ডায়াবেটিস মহামারিকে নিয়ন্ত্রণ ও জয়ে ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসের প্রতীক। প্রতিবছর আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিক সমিতি (আইডিএফ) একেকটি স্লোগান বা প্রতিপাদ্য ঠিক করে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধের ব্যাপারে বিশ্বব্যাপী সচেতনতা সৃষ্টির জন্য।

ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে বিশ্বব্যাপী চতুর্থ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার (২০২০-২০২৪) মূল প্রতিপাদ্য হলো ‘ডায়াবেটিস রোগকে জানা এবং নিয়ন্ত্রণ’।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবমতে, ২০০০ সালে ভিত্তি বছরে বিশ্বে ডায়বেটিক রোগীর সংখ্যা যেখানে প্রায় ১৭ কোটি (বিশ্ব জনসংখ্যার শতকরা প্রায় ৩ ভাগ) ছিল, তাদের আশঙ্কা, ২০৩০ সালে সে সংখ্যা দ্বিগুণের বেশি হয়ে যাবে। প্রাদুর্ভাবের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, উন্নত বিশ্বে টাইপ-২—অর্থাৎ ইনসুলিন নিরপেক্ষ রোগীর সংখ্যা ক্রমে বাড়ছে। আমাদের বাংলাদেশে সেই বিস্তারের হার ১৪৯ শতাংশ। একটি পরিসংখ্যান বলছে, বিশ্বে প্রতি আট সেকেন্ডে একজন লোক মারা যাচ্ছে ডায়াবেটিসে। সুষম খাদ্য, নিয়মিত ব্যায়াম, ওজন স্বাভাবিকে রাখা এবং ধূমপানে বিরত থেকে টাইপ-২ ডায়াবেটিক রোগীরা এ রোগ নিয়ন্ত্রণ বা প্রতিরোধ করতে সক্ষম হবেন।

রোগ হিসেবে যার বয়স হাজার বছরের, প্রসার-প্রতিপত্তিতে গজেন্দ্রগামী, আহ্বায়ক অনেক অসংক্রামকের, মহামারি আকারে যার বিস্তার-বীভৎসতায় ভাবিয়ে তুলছে গোটা বিশ্বকে—তাকে চিনতে, জানতে, নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধের নাকি এখনই সময়, সেই মহাসর্বনেশে শত্রুরূপী রোগটির নাম ডায়াবেটিস। গোটা বিশ্বে এখন প্রতি আট সেকেন্ডে একজন করে ডায়াবেটিক রোগী মারা যাচ্ছে—এই ভয়াবহ সংবাদ ভাবিয়ে তুলছে গোটা বিশ্বকেই। নীরব ঘাতক স্বভাবের ডায়াবেটিস রোগটি এমনিতে দেহে বহু ব্যাধির (চোখ, হার্ট, কিডনিসহ মূল্যবান অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ব্যাপক ক্ষতিসাধনে সক্ষম) আহ্বায়ক।

রক্তে শর্করার পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি হয়ে বেশি দিন ধরে থাকলে ডায়াবেটিস রোগ দেখা দেয়। সাধারণত ডায়াবেটিস বংশগত কারণে ও পরিবেশের প্রভাবে হয়। এ রোগ সব লোকেরই হতে পারে। ডায়াবেটিস একবার হলে আর সারে না। এটা সব সময়ের এবং আজীবনের রোগ। তবে আধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থা গ্রহণ করে এ রোগকে ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং প্রায় স্বাভাবিক জীবন যাপন করা সম্ভব হয়।

ডায়াবেটিস ছোঁয়াচে বা সংক্রামক রোগ নয়। বেশি মিষ্টি খেলে ডায়াবেটিস হয়—এ ধারণা ঠিক নয়। খাদ্য নিয়ন্ত্রণ, শৃঙ্খলা ও ওষুধ এ রোগ নিয়ন্ত্রণের উপায়। খাদ্যের গুণগত মানের দিকে নজর রেখে পরিমাণমতো খাদ্য নিয়মিত গ্রহণ, জীবনের সব ক্ষেত্রে নিয়ম-কানুন বা শৃঙ্খলা মেনে—অর্থাৎ কাজকর্মে, আহারে, চলাফেরায়, এমনকি বিশ্রামে ও নিদ্রায় শৃঙ্খলা মেনে চলা দরকার। নিয়ম-শৃঙ্খলাই ডায়াবেটিক রোগীর জিয়নকাঠি। রোগী যদি চিকিৎসকের সঙ্গে সহযোগিতা করে তার উপদেশ ও নির্দেশ ভালোভাবে মেনে চলে এবং রোগ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা যথাযথভাবে গ্রহণ করে, তবে সুখী, কর্মঠ ও দীর্ঘজীবন লাভ করতে পারে।

লেখক : সরকারের সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান। বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির সাবেক চিফ কো-অর্ডিনেটর

About Post Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *