মস্তিষ্কের জটিল রোগ আলঝেইমার চিকিৎসায় গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি অর্জন করেছেন গবেষকেরা। জার্মান সেন্টার ফর নিউরোডিজেনেরেটিভ ডিজিস (ডিজেডএনই) এবং এলএমইউ মেডিকেল সেন্টারের ইনস্টিটিউট ফর স্ট্রোক অ্যান্ড ডিমেনশিয়া রিসার্চের এক গবেষণায় দেখা গেছে, আলঝেইমার রোগের বিভিন্ন পর্যায়ে টিআরইএম-২ প্রোটিন (মাইলোয়েড কোষ-২) বেশ প্রভাব ফেলে। এই টিআরইএম-২ প্রোটিনের ফাংশনকে উদ্দীপ্ত করে আলঝেইমারের প্রভাব কমিয়ে আনা সম্ভব বলে মনে করছেন তাঁরা।
আলঝেইমার হলো মস্তিষ্কের একধরনের অস্বাভাবিকতা, যাতে সাধারণত স্মৃতিভ্রংশ হয়। এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির কগনিটিভ কার্যকারিতা বা পরিপার্শ্ব সম্পর্কে চেতনার ক্ষয় হতে থাকে। ৬৫ বছরের পর এ রোগ হওয়ার প্রবণতা বেশি। এই রোগের তেমন কোনো প্রতিকার নেই। রোগের প্রাবল্যের সঙ্গে সঙ্গে রোগীর শারীরিক অবস্থারও অবনতি হতে থাকে, খাওয়াসহ অন্যান্য দৈনন্দিন কাজ নিজে করতে না পারার কারণে রোগী একেবারেই পরনির্ভরশীল হয়ে পড়েন। মানুষের মস্তিষ্কে আলঝেইমার রোগের শুরুতে এটি রোগ দমনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
ডিজেডএনই ও এলএমইউর অধ্যাপক ক্রিশ্চিয়ান হাস ও মাইকেল ইউয়ারসের নেতৃত্বে এক নতুন গবেষণায় দেখা গেছে, আলঝেইমারে আক্রান্ত কোনো রোগীর অসুখের বিভিন্ন ধাপে যদি সেরিব্রোস্পাইনাল ফ্লুইডে উচ্চ মাত্রায় টিআরইএম-২ প্রোটিন পাওয়া যায়, তাহলে তাঁর সেরে ওঠার সম্ভাবনা বেশি। সেরিব্রোস্পাইনাল ফ্লুইডে টিআরইএম-২ প্রোটিন কম থাকলে আরোগ্য লাভের সম্ভাবনা কম থাকে।
তাহলে সেরিব্রোস্পাইনাল ফ্লুইড কী? আমাদের মস্তিষ্কের কেন্দ্রে কিছু গহ্বর বা ভেন্ট্রিকল রয়েছে, যেখান থেকে প্রতিদিন ৪৫০ সিসি পরিমাণ সেরিব্রোস্পাইনাল ফ্লুইড বা মস্তিষ্কের বিশেষ তরল তৈরি হয়। সাধারণভাবে বলতে গেলে সেরিব্রোস্পাইনাল ফ্লুইড নামক ওই লবণাক্ত তরলের মধ্যে আমাদের মস্তিষ্ক ভেসে থাকে। এই ফ্লুইডে উচ্চ মাত্রায় টিআরইএম-২ প্রোটিন থাকলে আলঝেইমার প্রতিরোধ সহজ হয়।
মস্তিষ্কে, টিআরএমই-২ প্রোটিন মাইক্রোগ্লিয়া দ্বারা উৎপাদিত হয়, যা মস্তিষ্কের প্রতিরোধক কোষ হিসেবে কাজ করে। মাইক্রোগ্লিয়া হলো মস্তিষ্ককে পরিষ্কার রাখার কাজের একটি অংশ। মাইক্রোগ্লিয়া কোষগুচ্ছ, স্নায়ুতন্ত্রের বর্জ্য এবং মৃত কোষের বর্জ্য পরিষ্কার করে। আমরা যখন ঘুমিয়ে থাকি তখন সারা দিনে জমা হওয়া ক্ষতিকর পদার্থগুলো পরিষ্কার হয়। এতে ঘুম থেকে ওঠার পর মস্তিষ্ক আবার ঠিকভাবে কাজ করতে পারে।
প্রথমে অধ্যাপক হাস ও তাঁর সহকর্মীরা একটি ইঁদুরের ওপর গবেষণা করে দেখেছিলেন। ওই গবেষণায় দেখা যায়, টিআরইএম-২ আলঝেইমার রোগের জন্য দায়ী বিষাক্ত প্রোটিনের সমষ্টি সংযুক্ত করে এবং এগুলো ধ্বংস করতে মাইক্রোগলিয়াকে সক্রিয় করে। গবেষণায় আরও দেখা যায় টিআরইএম-২ মস্তিষ্ককে আলঝেইমারের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষা করতে পারে। এখন প্রশ্ন হলো মানুষের মস্তিষ্ককে রক্ষা করার ক্ষমতা কি রয়েছে টিআরইএম-২–এর?
হাস ও ইউয়ারসের নেতৃত্বে একটি গবেষক দল কয়েক বছর ধরে আলঝেইমার রোগীর সেরিব্রাল মেরুদণ্ড তরলের (সিএসএফ) নমুনা এবং ওই ব্যক্তিদের অসুখ বেড়ে যাওয়ার হারের সঙ্গে টিআরইএম-২–এর একটি পরিসংখ্যানগত সম্পর্ক তৈরির চেষ্টা করেছেন। তাঁরা ৩৮৫ জন আলঝেইমার রোগীর নমুনা নেন। নানা গবেষণায় ইউয়ারস এবং হাস নিশ্চিত হয়েছেন যে এই রোগের সব পর্যায়ে টিআরইএম-২–এর উচ্চতর ঘনত্ব আরোগ্য লাভের জন্য কাজ করে। টিআরইএম-২–এর উপস্থিতিতে স্মৃতিশক্তির অস্থিরতা কম হয় এবং হিপোক্যাম্পাস সংকুচিত হওয়ার হার কম হয়। হিপোক্যাম্পাস হলো মানুষের মস্তিষ্কের একটি অংশ, যা নতুন কিছু শেখার ও স্মৃতির জন্য কাজ করে।
গবেষকেরা বলছেন, মাইক্রোগ্লিয়া সক্রিয় করে আলঝেইমার প্রতিরক্ষামূলক প্রভাব তৈরি করা হলে এটি অনেক সময় প্রদাহ তৈরি করতে পারে। এরপরও বলা যায়, আলঝেইমার রোগের ক্ষেত্রে মস্তিষ্কে প্রতিরোধ ক্ষমতা জাগিয়ে তুলতে মূল ভূমিকা রাখে টিইরইএম-২।
এই রোগের প্রাথমিক লক্ষণগুলো যখন দেখা যায়, তখনই সিএসএফে টিআরআরএম-২–এর ঘনত্ব বাড়ে। হাস বলেন, টিআরইএম-২–এর উৎপাদন থেকে বোঝা যায় মস্তিষ্কে ইতিমধ্যে ক্ষতি হয়ে গেছে কি না। গবেষকেরা ইতিমধ্যে একটি থেরাপিউটিক অ্যান্টিবডি তৈরি করেছেন, যা টিআরইএম-২ ফাংশনকে উদ্দীপ্ত করে এবং এর প্রতিরক্ষামূলক প্রভাব বাড়ায়।