বাংলাদেশে মিডওয়াইফ

সাকিলা মতিন মৃদুলা: পর্যাপ্ত জ্ঞানের অভাব এবং যথাযথ প্রশিক্ষণের অভাবে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে গর্ভবতী মা এবং নবজাতকের মৃত্যুর হার ছিল অনেক বেশি। প্রশিক্ষিত মিডওয়াইফ আজ দেশের আনাচে কানাচে। নিজেরাই প্রত্যন্ত অঞ্চলের ঘরে ঘরে গিয়ে সচেতন করে আসে সাধারণ মানুষকে। মা ও নবজাতক শিশু স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সারা বাংলাদেশের উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোতে কাজ করে যাচ্ছেন মিডওয়াইফগণ। মিডওয়াইফদের মূল দায়িত্ব হলো সফলতার সঙ্গে মা ও নবজাতক শিশু স্বাস্থ্যের পরিচর্যা, নরমাল ডেলিভারি করানোর মাধ্যমে অপ্রয়োজনীয় সিজারিয়ান প্রতিরোধ। বর্তমান সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী একজন মা গর্ভধারণের পর থেকে শুরু করে সন্তান প্রসব পরবর্তী ৪ মাস পর্যন্ত একজন মিডওয়াইফের সার্বিক তত্ত্বাবধানে থাকবেন।

উল্লেখ্য, পৃথিবীর অন্য দেশেগুলোতে দক্ষ ও প্রশিক্ষিত মিডওয়াইফ বহু বছর হতে পরিচিত হলেও বাংলাদেশে মিডওয়াইফেরি প্রফেশনটি ২০১০ সালে স্বীকৃতি লাভ করে। মিডওয়াইফদের সংঘবদ্ধভাবে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার সহায়তা করতে ২০১০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ মিডওয়াইফারি সোসাইটি (বিএমএস)।

একদিকে মিডওয়াইফরা গর্ভবতী মা এবং নবজাতক শিশুর কল্যাণে কাজ করছে। আবার অন্যদিকে তারা নিজেরাও স্বাবলম্বী হয়ে পরিবারের দায়িত্ব নিচ্ছে। অর্থনৈতিক মুক্তির ছোঁয়ায় আত্মবিশ^াসী হয়ে উঠছে।

এই যেমন তানিয়া আক্তার। একজন মিডওয়াইফ। পরিবারের বড় সন্তান। ছোটবেলা থেকে মানুষের সেবা করার ইচ্ছা থেকেই মিডওয়াইফারি প্রফেশনে আসা। যদিও এই প্রফেশনে আসার আগে মিডওয়াইফ বা মিডওয়াইফারি সম্পর্কে তেমন ধারণা ছিল না। ২০১২ সালে ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ঢাকা নার্সিং কলেজে তিন বছর মেয়াদি ডিপ্লোমা ইন মিডওয়াইফারি কোর্স করার মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু।

২০১৬ সালের মে মাসে ইউএনএফপিএ এবং বাংলাদেশ মিডওয়াইফারি সোসাইটির সহায়তায় ডেনমার্কের কোপেনহেগেন-এ ‘ডড়সবহ উবষরাবৎ ২০১৬’ কনফারেন্সে বাংলাদেশের মিডওয়াইফারিকে প্রদর্শন করার সুযোগ পায় তানিয়া। এমন সুযোগ পেয়ে আনন্দিত তানিয়ার আত্মবিশ^াস বেড়েছিল বহুগুন। বিভিন্ন ধরনের মানুষের সঙ্গে হয়েছিল বিভিন্ন ধরনের অভিজ্ঞতার আদান প্রদান যা পরবর্তীতে তানিয়া তার কর্মক্ষেত্রে অনেকভাবে কাজে লাগাতে পেরেছে।

২০১৬ সালের জুলাই মাসে সাইক্লোন ক্ষতিগ্রস্ত কুতুবদিয়া উপজেলার উত্তরধুরুং ইউনিয়নে মিডওয়াইফ হিসেবে যোগদান করে সে। এর আগে সেখানে কোন মিডওয়াইফারি সেবা দেয়া হতো না। তানিয়ার ভাষ্যে- ‘দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার কারণে সেন্টারটি দেখতে অনেকটা ভূতের বাড়ি মনে হচ্ছিল আমার। অনেক চিন্তিত হয়ে পড়ি আমি। কিভাবে কাজ করব কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। তবুও আশা ছাড়িনি। পরিবার পরিকল্পনা পরিদর্শককে সঙ্গে নিয়ে কমিউনিটিতে গেলাম। স্থানীয় লোকজন এবং চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বললাম এবং তাদের জানাতে চেষ্টা করলাম যে- আমি কে, কি আমার কাজ, কিভাবে আমি তাদের সেবা দিব। প্রথমে একটু কম সাড়া পেলেও পরবর্তীতে ভালই সাড়া পাই আমি।’ ধীরে ধীরে অনেক গর্ভবতী মা আসা শুরু করেন গর্ভকালীন চেকআপ করানোর জন্য। আস্তে আস্তে নরমাল ডেলিভারি ও প্রসবপরবর্তী সেবাও চালু হয়ে যায়। মাঝে মাঝে কমিউনিটিতে গিয়ে সচেতনতামূলক সমাবেশ করা হয়। ফেসিলিটি ডেলিভারি করানোর সুবিধার সঙ্গে সঙ্গে একজন দক্ষ মিডওয়াইফ দ্বারা ডেলিভারি করানোর সুবিধা সম্পর্কে জানতে পারে সকলে। এই পথটা খুব সহজ ছিল না।

আশপাশের লোকজন আস্তে আস্তে বিশ্বাস করতে শুরু করে, জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে মিডওয়াইফারি সেবার। একত্রিতভাবে আমাদের একদিকে মিডওয়াইফদের বলিষ্ঠ এবং আত্মসচেতনতায় কাজ করতে হবে। অন্যদিকে বাংলাদেশে মাতৃসেবার উন্নয়নে মিডওয়াইফদের ভূমিকা জোরালো এবং সুস্পষ্ট করতে তাদের সহযোগিতায় দৃঢ়সঙ্কল্পবদ্ধ হতে হবে।

About Post Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *