স্থূলতা মহামারিতে প্রতি বছর মৃত্যু হচ্ছে ত্রিশ লাখ মানুষের

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭৫ সালের পরে বিশ্বে স্থূলতার হার প্রায় তিনগুণ বেড়ে গেছে। জাতিসংঘের এই এজেন্সি ধারণা করছে, ২০১৬ সালে বিশ্বে একশো নব্বুই কোটির বেশি মানুষের ওজন অতিরিক্ত ছিল, যাদের মধ্যে ৬৫ কোটি মানুষ স্থূলতা রয়েছে।

এই সংখ্যা থেকে বুঝতেই পারা যায় কেন নানা ক্ষেত্রের মানুষজন ‘স্থূলতার মহামারি’ শব্দ ব্যবহার করতে শুরু করেছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে এই রোগে প্রতি বছর অন্তত ত্রিশ লাখ মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। বিজ্ঞানী এবং নীতি নির্ধারকরা সতর্ক করে দিয়েছেন যে, যেভাবে স্থূলতার বিষয়টি মোকাবেলা করা হচ্ছে তা ভুল এবং কুসংস্কার নির্ভর হয়ে পড়েছে। কিন্তু মোটা হওয়া বা স্থূলতার বিরুদ্ধে এই লড়াইয়ে কোনটা সত্যি আর কোনটা মিথ্যা? এসব প্রশ্নের উত্তর হয়তো আপনাকে অবাক করে দেবে।

স্থূলতা একটি রোগ, পছন্দের ব্যাপার নয় :

স্থূলতা মহামারিতে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত দেশের অন্যতম হলো যুক্তরাষ্ট্র।

আমেরিকান স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা ধারণা করছেন যে, দেশটির ৩৬ শতাংশের বেশি জনগোষ্ঠী এখন স্থূলতায় ভুগছে। ২০১৩ সাল থেকে স্থূলতাকে একটি রোগ হিসাবে বিবেচনা করে আসছে আমেরিকান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন।

তা সত্ত্বেও, ২০১৮ সালেও চিকিৎসকদের সংবাদ পোর্টাল ‘মেডস্কেপে’র জরিপে দেখা গেছে, দেশটির ৩৬ শতাংশ চিকিৎসক আর ৪৬ শতাংশ সেবিকা এটিকে রোগ বলে মনে করেন না। ৮০ শতাংশ চিকিৎসক উত্তর দিয়েছেন যে, স্থূলতার পেছনের বড় কারণটি হলো জীবনযাপনের ধারা।

তবে ব্রিটিশ সাইকোলজিক্যাল সোসাইটি থেকে গত সেপ্টেম্বর মাসে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্থূলতা কোন পছন্দের ব্যাপার নয়।

”শারীরিক এবং মানসিক কিছু বিষয় পরিবেশ ও সামাজিক প্রভাবের সঙ্গে একত্রিত হয়ে মানুষের অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলতা কারণ তৈরি হয়।” ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

‘স্থূলতাকারো ইচ্ছা অনিচ্ছার ব্যাপার নয়’ :

১৯৯০ এর দশক থেকেই বিজ্ঞানীরা ধারণা করে আসছেন যে, স্থূলতার সঙ্গে বংশগত সম্পর্ক রয়েছে। গত জুলাই মাসে নরওয়েজিয়ান ইউনিভার্সিটি অফ সায়েন্স এন্ড টেকনোলজির একদল গবেষক আবিষ্কার করেন যে, যাদের পরিবারের পূর্বে স্থূলতার ইতিহাস রয়েছে, তাদের বংশধরদের মধ্যে এটির বিস্তারের ঝুঁকিও বেশি। যা সাম্প্রতিক দশকগুলোয় অনেক বেশি দেখা যাচ্ছে। উচ্চতার সঙ্গে ওজন মিলিয়ে সহজেই বুঝতে পারা যায় যে, আমাদের ওজন ঠিক এবং স্বাস্থ্যসম্মত আছে কিনা। ওই দলটি নরওয়ের একলক্ষ উনিশ হাজার মানুষের ওপর গবেষণা করেছে, যারা নিয়মিতভাবে তাদের উচ্চতার সঙ্গে ওজন মেপেছেন। সেখানে দেখা গেছে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে উচ্চতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে তাদের ওজন বেড়েছে। কিন্তু জিনগত কারণে কিছু মানুষের ওজন অতিরিক্ত বেড়ে গেছে।

”বর্তমানে ৩৫ বছর জিনগত প্রবণতার কারণে বয়সী একজন গড় উচ্চতার নরওয়েজিয়ানের ওপর প্রায় সাত কেজি বেশি হয়ে থাকে, যা অন্যদের ক্ষেত্রে দেখা যায় না,” বলছেন মারিয়া ব্রান্ডকভিস্ট, ওই দলের একজন গবেষক।

‘অতিরিক্ত ওজন সবসময়ের জন্য অস্বাস্থ্যকর’ :

অতিরিক্ত ওজন এবং স্বাস্থ্যগত জটিলতার ব্যাপারটি অনেকেরই জানা এবং অনেকটাই প্রমাণিত একটি ব্যাপার। তবে সাম্প্রতিক গবেষণায় প্রশ্ন উঠেছে যে, অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলতা সবসময়েই কারো স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর কিনা? ২০১২ সালে ইউরোপিয়ান সোসাইটি অফ কার্ডিওলোজি বড় একটি গবেষণার প্রতিবেদন প্রকাশ করে যেখানে স্থূলতা নিয়ে প্রচলিত কিছু ধারণার বিপরীত তথ্য তুলে ধরা হয়। সেখানে দেখা যায় যে, কিছু মানুষের স্থূলতা থাকলেও সত্ত্বেও হজমের দিক থেকে স্বাস্থ্যবান এবং সুস্থ রয়েছেন, সাধারণ মানুষের তুলনায় হৃদরোগ বা ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ার কোন ঝুঁকিতে নেই। তারা উচ্চ কোলেস্টেরল, রক্তচাপে ভোগেন না এবং অন্য স্থূল মানুষদের চেয়ে অনেক বেশি শারীরিকভাবে সুস্থ থাকেন। অনেকগুলো দীর্ঘস্থায়ী রোগের সঙ্গে স্থূলতার সম্পর্ক রয়েছে বলে সবাই জানে, যেমন হৃদরোগ ও ক্যান্সার। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, স্থূল মানুষদের মধ্যেও এমন কিছু মানুষ আছেন যাদের এরকম বিপাকীয় জটিলতায় ভুগতে হয় না.” লিখেছেন ইউনিভার্সিটি অফ গ্রানাডা ইন স্পেনের অধ্যাপক ফ্রান্সিসকো অর্টেগা, যিনি ওই প্রতিবেদনের প্রধান লেখক।

”চিকিৎসকদের এই বিষয়টি বিবেচনায় নেয়া উচিত যে, সব স্থূল মানুষের একই ধরণের সমস্যা থাকে না।”

‘সব ক্যালোরি একই রকম’ :

ওজন নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে ‘বেশি না খাওয়া’ নীতি হচ্ছে সবচেয়ে ভালো নীতি। কিন্তু খাবারের ক্ষেত্রে ক্যালোরির পরিমাপের চেয়ে ক্যালোরির মানের বিষয়টি কি বেশি গুরুত্ব পাওয়া উচিত নয়?

স্বাস্থ্যকর খাবারের বর্ণনা করতে গিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছেন, একজন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের প্রতিদিন গ্রহণ করা ক্যালোরির পরিমাণ হওয়া উচিত ২০০০ ক্যালোরি। কিন্তু সেখানে সতর্কবাণীও আছে। সংস্থাটি পরামর্শ দিয়েছে যে, ওই ক্যালোরির ৩০ ভাগেরও কম আসা উচিত চর্বিযুক্ত খাবার থেকে। ২০১১ সালের হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, ‘ক্যালোরি মানে শুধু ক্যালোরি নয়’ এবং কিছু খাবারের কারণে দীর্ঘদিন ধরে ওজন বাড়তে পারে। গবেষকরা চারবছর পর পর ১ লাখ ২০ হাজার স্বাস্থ্যবান পুরুষ ও নারীর ওপর গবেষণা করেছেন যাদের বয়স সর্বোচ্চ বিশ বছর। গবেষণায় অংশগ্রহণকারীরা প্রতি চার বছরে গড়ে ১.৫২ কেজি ওজন বেড়েছে আর পুরো বিশ বছরে ওজন বেড়েছে ৭.৬ কেজি।

ওজন বাড়ার পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে প্রক্রিয়াজাত খাবার, পরিশোধিত শস্য, চর্বি এবং চিনি। শুধুমাত্র ফ্রেঞ্চ ফ্রাই খাওয়ার কারণে প্রতি চার বছরে দেড় কেজি ওজন বেড়েছে। অন্যদিকে বেশি পরিমাণে সবজি খাওয়ার কারণে ওজন উল্টো ০.০৯ কেজি কমে গেছে। গবেষণায় বলা হয়েছে, ” কম ক্যালোরিযুক্ত খাবার খাওয়ার কৌশল সবচেয়ে ভালো কাজ দেবে তখনি যখন, বিশেষ কিছু খাবার এবং পানীয় কম (বা বেশি) পরিমাণে খাওয়া হবে।”

‘ওজন কমানো নিয়ে হতাশা এড়াতে হলে আমাদের অবশ্যই বাস্তববাদী হতে হবে’ :

অনেক বেশি প্রত্যাশা করা না হলে সেটি জীবনের জন্য একটি ইতিবাচক দিক হতে পারে। তবে গবেষণা বলছে, উচ্চকাঙ্খী লক্ষ্যমাত্রা এর ওজন কমানোর ক্ষেত্রে নেতিবাচক কোন সম্পর্ক নেই। আমেরিকান অ্যাকাডেমি অফ নিউট্রিশন এন্ড ডায়েটিক্স এর একটি জার্নালে ২০১৭ সালের একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, মারাত্মক স্থূলতায় ভোগা ৮৮জন ব্যক্তির মধ্যে ওজন কমানোর উচ্চাকাঙ্ক্ষা অনেক ভালো ফল এনেছে।

‘শুধুমাত্র ধনী দেশগুলোয় স্থূলতার সমস্যা আছে’ :

অবশ্যই উন্নত দেশগুলোয় স্থূলতার হার অনেক বেশি, কিন্তু বিশ্বের স্থূলতার তালিকার দিকে তাকালে অনেককেই অবাক হতে হবে। স্থূলতার ব্যাপকতার দিক থেকে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হলো প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপ, আমেরিকান সামোয়া, যেখানে বাসিন্দাদের ৭৫ শতাংশই স্থূলতায় আক্রান্ত বলে ধারণা করা হয়। এটা সত্যি যে এসব দ্বীপের মানুষদের সংখ্যা অনেক কম। কিন্তু বেশি জনগোষ্ঠী রয়েছে, এমন উন্নয়নশীল দেশ- যেমন মিশর ও তুরস্কে-৩২ শতাংশ মানুষ স্থূলতায় ভুগছে (২০১৬ সালের বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য।)

”সামাজিক বৈষম্যের কারণে তৈরি হওয়া অন্যতম একটি জিনিস হলো স্থূলতা। যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে বেশি স্থূলতার রাজ্য হলো আরাকানসাস, যেটি দেশের চতুর্থ গরীব রাজ্য। সবচেয়ে দরিদ্র রাজ্য মিসিসিপি স্থূলতার দিক থেকে তৃতীয় অবস্থায় রয়েছে।” বলছেন মার্টিন কোহেন, যিনি ‘ খাবার আগে আমি ভাবি’ নামের বই লিখেছেন। যুক্তরাজ্যে ২০১৫-২০১৬ সালের জাতীয় স্বাস্থ্য সেবার তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে যে, সচ্ছল এলাকাগুলোর তুলনায় সবচেয়ে অসচ্ছল এলাকা গুলোয় বসবাসকারী শিশুদের মধ্যে স্থূলতার হার প্রায় দ্বিগুণ। গবেষকরা বলছেন, এই তারতম্যের প্রধান কারণ হলো, স্বাস্থ্যকর খাবারের দাম অনেক বেশি।

‘বুকের দুধের সঙ্গে স্থূলতার কোন সম্পর্ক নেই’

গত কয়েক দশক ধরে বুকের দুধের বিকল্প হিসাবে গুড়া দুধের ব্যাপক প্রচারণা চালানো হয়েছে। কিন্তু গত এপ্রিল মাসে প্রকাশিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গবেষণায় জানা যাচ্ছে যে, বুকের দুধ খাওয়ার কারণে শিশুর স্থূল হওয়ার ঝুঁকি অনেকটা কমে যেতে পারে। ইউরোপের ১৬টি দেশের ৩ লাখ শিশুর ওপর গবেষণা করে বিজ্ঞানীরা দেখতে পেয়েছেন, যে শিশুরা কখনো বুকের দুধ খায়নি, তাদের স্থূল হওয়ার সম্ভাবনা ২২ শতাংশ বেড়ে গেছে।

যদিও বিশেষজ্ঞরা এটাও বলছেন, যে নারী বুকের দুধ খাওয়াবেন, তার স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের ব্যাপারটিও এক্ষেত্রে অনেকটা ভূমিকা রাখে। তারপরেও স্থূলতার বিরুদ্ধে বুকের দুধের ভূমিকা অকাট্য, বলছেন গবেষক জায়ো ব্রেডা।

”বুকের দুধের সত্যিই অনেক সুরক্ষা গুণ রয়েছে। সেসব প্রমাণ রয়েছে। এর সুবিধা যে এতো অসামান্য সেটি মানুষকে জানানো উচিত।”

সূত্র : বিবিসি বাংলা

About Post Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *