মানসিক রোগ প্রতিরোধ ও স্বাস্থ্য উন্নয়ন

১০ অক্টোবর বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস। বেশ কয়েক বছর ধরেই বিভিন্ন সংগঠন, প্রতিষ্ঠান এবং মিডিয়া দিবসটিকে বেশ গুরুত্ব দিয়েই পালন করে আসছে। প্রতিদিন মানসিক স্বাস্থ্যের বিভিন্ন দুরবস্থা সবার সামনে প্রকাশ পাচ্ছে। শিশু থেকে বৃদ্ধ, নারী-পুরুষ, ব্যক্তিগত, পারিবারিক, কর্মক্ষেত্র এবং সামাজিক জীবনসহ সব ক্ষেত্রে পড়ছে এর প্রত্যক্ষ ছায়া। গবেষণার ফল বলছে, প্রতি পাঁচজন মানুষের ভেতর অন্তত একজন মানুষ কোনো না কোনো মানসিক রোগে ভুগেছে। এর প্রায় ৫০ শতাংশ কখনো সেই সমস্যার জন্য চিকিৎসা নিতে যায় না। আমাদের দেশের গবেষণার ফল হলো দেশের ১৬ কোটি মানুষের ভেতর প্রায় দুই কোটিই মানসিক রোগে আক্রান্ত। দুই কোটি অসুস্থ মানুষ মানে দুই কোটি মানুষের ডিজিজ বার্ডেন অন্যদের বয়ে বেড়াতে হয়। অথচ বর্তমান সময়ে মানসিক রোগের চিকিৎসা অনেক আধুনিক। এমনকি অনেক কার্যকরও। যদিও রোগ, রোগী বা সমস্যার তুলনায় তা সারিয়ে তোলার মানুষ যথেষ্টই কম আছে। আছে মাত্র আড়াই শর মতো মানসিক রোগবিশেষজ্ঞ, ৬০ জনের মতো ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট। তবে এ অবস্থা দ্রুতই পরিবর্তন হচ্ছে। মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে বর্তমান সরকারের আরো একটি উল্লেখযোগ্য কর্ম ছিল, মানসিক স্বাস্থ্য আইন-২০১৮।

বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস মূলত মানসিক রোগ তথা মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করার জন্যই পালন করা হয়।

World Federation for Mental Health, সংক্ষেপে WFMH ১৯৯২ সালের ১০ অক্টোবর সারা বিশ্বের মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক কার্যক্রম ও কর্মযজ্ঞকে একটি বিন্দুতে নিয়ে আসে এবং এ বিষয়ে বিশ্বের সব মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য বিশেষ এই দিবসটি পালন শুরু করে। শুরুতে বিশ্বের ১২৭টি দেশে একই সঙ্গে একটি দুই ঘণ্টার লাইভ টেলিভিশন শো দিয়ে দিবসটি পালন করা হয়। একইভাবে চলে আরো দুই বছর। পরবর্তীকালে WFMH, অতিরিক্ত খরচ কমানোর জন্য এ পদ্ধতি পরিবর্তন করে এবং প্রতিবছর একটি নির্দিষ্ট প্রতিপাদ্য ঠিক করে, সে অনুযায়ী বিভিন্ন শিক্ষাসূচি তৈরি করে তা সবার কাছে বিলি করার সিদ্ধান্ত নেয়। এ বছরের প্রতিপাদ্য ঠিক করা হয় আত্মহত্যার ওপর।

MENTAL HEALTH PROMOTION AND SUICIDE PREVENTION বাংলায় বলা যায়, মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়ন ও আত্মহত্যা প্রতিরোধ। মূলত আত্মহত্যা প্রতিরোধের ওপরই জোর দেওয়া হয়েছে।  সারা পৃথিবীর বিভিন্ন গবেষণা এবং প্রত্যক্ষণে যে বিষয়টি বের হয়ে এসেছে, তা সত্যিই উদ্বেগজনক। বিশেষ করে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের উদ্বেগটাই বেশি। আত্মহত্যা এমন একটি হত্যা, যেখানে একজন মানুষ তার নিজেকেই হত্যা করে। কেন করবে, এমন তো করার কথা নয়। কারণ খুঁজতে গিয়ে একটা বিষয় স্পষ্ট হয়, তা হলো যারা আত্মহত্যা করে, তাদের প্রায় ৯০ শতাংশ, অর্থাৎ প্রতি ১০ জনের ভেতর ৯ জন কোনো না কোনো মানসিক রোগে ভোগে। সাধারণ প্রতিক্রিয়া হলো, আত্মহত্যার প্রধান কারণ মানসিক রোগ। গবেষণা আরো বলছে, পৃথিবীতে প্রতি ৪০ সেকেন্ডে একজন মানুষ আত্মহত্যা করে। প্রতি দুই থেকে তিন সেকেন্ডে একজন আত্মহত্যার চেষ্টা করে। বলা যায়, এই মুহূর্তে এটিই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বিপর্যয়। যত মানুষ দুর্ঘটনায় মরে, যত মানুষ অন্য যেকোনো ধরনের বিপর্যয়ে মারা যায়, নিশ্চিতভাবে বলা যায়, আত্মহত্যা এর  অন্যতম।

বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস পালনের উদ্দেশ্য হলো মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক সচেতনতা। যেহেতু সারা পৃথিবীতেই এই দিবস পালন করা হয়, তাই দেখা যায় পৃথিবীর সব দেশের, সব মানুষের একটি কমন বিষয়কেই প্রতিপাদ্য করা হয়। এতে করে বৈশ্বিক সমস্যার একটা চিত্র ও সমাধানের পথ বের হয়ে আসে। কিন্তু নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর বা নির্দিষ্ট জাতির সমস্যা ভিন্ন হতেও পারে। আমাদের উচিত সে বিষয়গুলো যথাযথভাবে নির্ধারণ করা এবং সেই মতো সচেতনতাসহ সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া। শুধু নির্দিষ্ট দিনটিতেই সচেতনতা প্রচার না করে সারা বছর ধরে মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতাবিষয়ক কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া।

মনকে যদি ছোটকাল থেকেই একজন মানুষ সঠিকভাবে তৈরি করতে বা উপভোগ করতে না পারে, তাহলে আর মানসিক স্বাস্থ্য থাকল কোথায়? মানসিকভাবে সঠিক, সুন্দর আর সুস্থ থাকতে হলে পরিবার আর বিদ্যালয়কে প্রথম দায়িত্ব নিতে হবে। মানসিক রোগ, রোগের প্রতিরোধ এবং মানসিক স্বাস্থ্য উন্নয়নসহ ব্যক্তির ক্ষমতা বা দক্ষতার পূর্ণ ব্যবহার করতে হলে শুরু করতে হবে শুরু থেকেই। সূত্র কালের কণ্ঠ।

লেখক : ডা. সালাহ্উদ্দিন কাউসার বিপ্লব, চেয়ারম্যান ও অধ্যাপক, মনোরোগবিদ্যা বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়

About Post Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *