বর্তমান বিশ্বে চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। বিশ্বে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু ঘটায় এমন প্রধান পাঁচটি রোগের মধ্যে ডায়াবেটিস অন্যতম। পৃথিবীতে প্রতি ১০ সেকেন্ডে একজন ডায়াবেটিস আক্রান্ত মানুষ মারা যায় এবং প্রতি ১০ সেকেন্ডে দুইজন ডায়াবেটিস রোগী শনাক্ত করা হয়। বহুমূত্র বা ডায়াবেটিস হরমোন সংশ্লিষ্ট রোগ। দেহযন্ত্র অগ্ন্যাশয় যদি যথেষ্ট ইনসুলিন তৈরি করতে না পারে অথবা শরীর যদি উৎপন্ন ইনসুলিন ব্যবহারে ব্যর্থ হয়, তাহলে এই রোগ হয়। খবর রাইজিংবিডির।
ইনসুলিন, জীবন ধারা পরিবর্তন, অ্যান্টি ডায়াবেটিক ওষুধ, নিয়মিত ব্যায়াম, খাদ্য গ্রহণে সচেতনতা এবং অসুখ সম্বন্ধে রোগীর প্রয়োজনীয় ধারণা ডায়াবেটিস রোগীকে সুস্থ রাখে। এর মধ্যে খাদ্য গ্রহণে সচেতনতা গুরুত্বপূর্ণ। ডায়াবেটিস রোগী চাইলেই মিষ্টি ইচ্ছেমতো খেতে পারেন না। ইচ্ছা থাকলেও পছন্দের খাবার খাওয়া হয়ে ওঠে না। যে কারণে অনেকেই প্রবলভাবে অনুভব করেন অ্যান্টি-ডায়াবেটিক খাবার।
একবার ভাবুন, এমন মিষ্টান্ন যদি হয়, ধরুন মিষ্টি বিস্কুট অথচ খেলে ডায়াবেটিস রোগীর কোনো সমস্যা হবে না- তাহলে কেমন হতো? এমনই এক অ্যান্টি-ডায়াবেটিক বিস্কুট উদ্ভাবন করেছেন দিনাজপুরের হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োকেমিস্ট্রি অ্যান্ড মলিকুলার বায়োলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. মো. ইয়াছিন প্রধান।
তিনি যে কোনো উপলক্ষ্যে যখন দিনাজপুর শহরের বিভিন্ন মিষ্টির দোকানে যেতেন তখন প্রায়ই লক্ষ্য করতেন ডায়াবেটিস রোগীর জন্য আলাদা এক ধরনের মিষ্টি চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে। বিষয়টি দেখে অবাক হন তিনি- ডায়াবেটিস রোগীর জন্য মিষ্টি! তিনি মিষ্টিগুলো কী দিয়ে তৈরি, কীভাবে তৈরি হতে পারে ভাবতে থাকেন। মিষ্টিতে ব্যবহৃত দ্রব্য সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে তিনি জানতে পারেন সেখানে স্যাকারিন ব্যবহৃত হয়েছে যা কৃত্রিমভাবে তৈরি। অথচ স্যাকারিন বা সোডিয়াম সাইক্লোমেট খেলে রক্তে চিনির পরিমাণ না বাড়লেও, দীর্ঘদিন খেলে ডায়াবেটিস বেড়ে যেতে পারে৷ তাই কৃত্রিম উপায়ে তৈরি স্যাকারিন মুখে মিষ্টির স্বাদ এনে দিলেও, তা আদৌ কতটা গ্রহণযোগ্য তা প্রশ্ন সাপেক্ষ৷ ডায়াবেটিস রোগীদের এই ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করতে তিনি গবেষণায় মনোযোগী হলেন। একসময় স্যাকারিনের বিকল্প হিসেবে পেয়েও গেলেন স্টেভিওল গ্লাইকোসাইড।
ড. মো. ইয়াছিন প্রধান বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স ডিগ্রির জন্য থিসিস করার সময় স্টেভিওল গ্লাইকোসাইড-এর উৎস স্টেভিয়া গাছ সম্পর্কে জানতে পারেন। গাছটির পাতা বিপরীত দিকে অবস্থিত, খাজকাটা, আঁশ আছে, গাঢ় সবুজ। গাছগুলো সুগন্ধ ছড়ায় না কিন্তু পাতা মিষ্টি। স্টেভিয়ার পাতা চিনি অপেক্ষা ৩০-৪০ গুণ এবং পাতার স্টেভিয়াসাইড চিনি অপেক্ষা ৩০০ গুণ বেশি মিষ্টি। সুতরাং তিনি ভাবলেন, চিনির বিকল্প হিসেবে জিরো ক্যালরি স্টেভিয়ার পাতা ব্যবহার করা যায়। গবেষণার এই পর্যায়ে এসে তিনি দেখলেন কিছু নার্সারিতে স্টেভিয়া চাষ হচ্ছে এবং তারা চারা বিক্রির পাশাপাশি পাতা শুকিয়ে গুঁড়া করে উচ্চ দামে বাজারজাতও করছে। বিক্রিও কম নয়। ডায়াবেটিস রোগীরাই এর মূল ক্রেতা।
জানার পর শুরু হয় ড. মো. ইয়াছিন প্রধানের নতুন অধ্যায়। গাছের মিষ্টি কম্পাউন্ড বাড়ানো কমানো কিংবা অন্য কিছু যোগ করার মাধ্যমে ত্বরান্বিত করা যায় কি না- শুরু হয় নতুন গবেষণা। কিন্তু ততদিনে তিনি আর ছাত্র নন, হয়ে গেছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। শিক্ষক হওয়ার পরও থেমে যাননি। হাই পারফরম্যান্স লিকুইড ক্রোমোটোগ্রাফি করার মাধ্যমে পাতার মধ্যে কি পরিমাণ গ্লাইকোসাইড আছে তা নির্ণয় করেন। তারপরই পিএইচ.ডি ডিগ্রির জন্য পাড়ি জমান জাপানে। ডিগ্রি শেষে দেশে শিক্ষকতার জন্য ফিরে এলে স্টেভিয়া গাছ থেকে স্টেভিওল গ্লাইকোসাইড বা স্টেভিয়া গাছ থেকে উৎপন্ন চিনি খাদ্যদ্রব্যে মিশিয়ে অ্যান্টি-ডায়াবেটিক খাদ্য উৎপাদন করার পরিকল্পনা করেন।
এই কাজে প্রাথমিকভাবে অর্থায়নের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করেন। সেই অর্থায়নে শুরু হয় গবেষণা। স্টেভিয়া গাছ চাষ শুরু করেন তিনি। তারপর প্রাকৃতিক মিষ্টিদ্রব্য স্টেভিরল গ্লাইকোসাইড সংগ্রহ করেন। এছাড়া ডিম, কেক থেকে শুরু করে বিস্কুট তৈরির সব ধরনের উপাদান কিনে স্টেভিরল গ্লাইকোসাইড মিষ্টান্ন হিসেবে ব্যবহার করে গবেষণাগারে তৈরি করে ফেলেন অ্যান্টি-ডায়াবেটিক বিস্কুট। শুধু বিস্কুট তৈরিতে সফল হলেই হবে না, বিস্কুটের কোনো পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া থাকবে কি না পর্যবেক্ষণ করা চাই। পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য তিনি বেছে নেন খরগোশ। তৈরিকৃত বিস্কুট খাইয়ে খরগোশের রক্ত পরীক্ষা করে দেখা গেল কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া নেই। এরপর মানুষের ক্ষেত্রেও একই ফল পাওয়ায় সফলভাবে উদ্ভাবিত হলো অ্যান্টি-ডায়াবেটিক বিস্কুট। এই গবেষণায় তাকে তারই তত্ত্বাবধানে থাকা তিন শিক্ষার্থী সেলিম রেজা, মিল্লাতুন মমিন ও শামসুল আলম সহযোগিতা করেন। উৎসাহের ব্যাপার ড. মো. ইয়াছিন প্রধানের ছাত্র মুজাউল আলম তাকে ২০ শতাংশ জমি উপহার দিয়েছেন স্টেভিয়ার চাষ করার জন্য। এরপর থেকে তিনি অন্যান্য ডায়াবেটিক প্রডাক্ট নিয়ে কাজ করছেন। অ্যান্টি ডায়াবেটিক দধি তৈরিতে ব্যর্থ হলেও অ্যান্টি ডায়াবেটিক চা তৈরিতে অনেকটা সফলতা পেয়েছেন বলে জানান তিনি।
অ্যান্টি-ডায়াবেটিক বিস্কুটের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে ড. মো. ইয়াছিন বলেন, ‘আমরা যেহেতু সলিড স্টেভিরল গ্লাইকোসাইড অর্থাৎ চিনি দেশের বাইরে থেকে আমদানি করছি সেহেতু খরচ অনেক বেশি পড়ে। যার কারণে বাণিজ্যিকভাবে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। স্টেভিরল গ্লাইকোসাইড পানিতে দ্রবণীয় হওয়ায় লিকুইড সুগার সল্যুশন তৈরির মাধ্যমে ব্যবহার করতে পারলে সস্তায় অ্যান্টি-ডায়াবেটিক খাদ্যদ্রব্য তৈরি করা যাবে। সেটা নিয়েও কাজ করছি। আশার কথা আমি ইতোমধ্যেই প্লান্ট থেকে সুগার তৈরি করেছি। যদিও বিষয়টি নিয়ে আরো কাজ করতে হবে। এটি এখন পর্যন্ত কোথাও ব্যবহার করা হয়নি। একে প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে সহজ কোনো পদ্ধতিতে উৎপাদন করে বাণিজ্যিকভাবে বাজারজাতকরণের পরিকল্পনা আছে।’