স্বাস্থ্যবিধি এবং নিরাপদ পানি

গত কয়েক দশকে বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্য খাতে বেশ উন্নতি হয়েছে। গড় আয়ু বেড়েছে, পুষ্টি পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে; নবজাতক ও প্রসূতিদের মৃত্যুর হার কমেছে। এই সব ক্ষেত্রেই অগ্রগতি হচ্ছে। তা সত্ত্বেও বলা যাবে না যে জাতীয় অর্থনীতির বিকাশের সঙ্গে এই খাতের অগ্রগতি সামঞ্জস্যপূর্ণ। অর্থনৈতিক অগ্রগতির সুফল সমাজের সব অংশের কাছে পৌঁছাতে পারছে না। নিম্ন আয়ের বিপুল জনগোষ্ঠীর খাদ্য, পুষ্টি ও সার্বিক স্বাস্থ্যগত অবস্থার উন্নয়নে এখনো অনেক কিছু করণীয় আছে। যেমন বিশুদ্ধ বা নিরাপদ খাওয়ার পানির প্রাপ্তি নিশ্চিত করা, কার্যকর পয়োনিষ্কাশন ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বাসস্থান-গৃহস্থালি ও কর্মস্থলের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করা এবং ব্যক্তি, পরিবার ও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণের সংস্কৃতি গড়ে তোলা। বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ হলো, স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোর সামর্থ্য ও দক্ষতা বাড়ানো এবং সার্বিক ব্যবস্থাপনা উন্নত করা।

নিরাপদ খাওয়ার পানির ঘাটতি একটি বৈশ্বিক সমস্যায় পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশেও এই সমস্যা ক্রমেই বাড়ছে। রাজধানী ঢাকায় ওয়াসার সরবরাহ করা পানি অনেক এলাকার মানুষ নিয়মিত পায় না। দক্ষিণাঞ্চলীয় জেলাগুলোতে লবণাক্ততা বাড়ার ফলে নিরাপদ পানির সংকট প্রকটতর হচ্ছে। লবণাক্ত খাওয়ার পানি ওই এলাকায় প্রসূতি মৃত্যুর উচ্চ হারের বিশেষ কারণ হিসেবে এক গবেষণায় জানা গেছে। অনেক এলাকার ভূগর্ভস্থ পানিতে আর্সেনিকের মাত্রা বেশি থাকা বিরাট স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ হচ্ছে। আর স্যানিটেশন ও হাইজিনের মান সারা দেশেই এখনো নিম্নপর্যায়ে রয়ে গেছে। গ্রামাঞ্চলের মনুষ্য বর্জ্য নিষ্কাশনে কিছুটা উন্নতি হয়েছে বটে, কিন্তু স্বাস্থ্যবিধি বা হাইজিন সম্পর্কে জনসচেতনতার অভাব এখনো ব্যাপক। গৃহস্থালির স্যানিটেশন ও হাইজিনের বিশেষ উন্নতি ঘটেনি। 

স্বাস্থ্য পরিস্থিতির সঙ্গে চিকিৎসাব্যবস্থার সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। সরকারি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোয় পর্যাপ্তসংখ্যক চিকিৎসক ও নার্সের ঘাটতি বেশ আলোচিত সমস্যা। এই সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া অবশ্যপ্রয়োজন। তবে শুধু চিকিৎসক ও নার্স দিয়ে রোগীদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। কার্যকর রোগচিকিৎসা নিশ্চিত করতে হলে হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোর কিছু বনিয়াদি প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতাও নিশ্চিত করতে হবে। যথা: বিশুদ্ধ বা নিরাপদ পানির পর্যাপ্ত ব্যবস্থা রাখতে হবে, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বা স্যানিটেশন এবং হাইজিন বা স্বাস্থ্যবিধির অনুশীলন নিশ্চিত করতে হবে। দেখা যাচ্ছে, আমাদের সরকারি ও বেসরকারি উভয় খাতের হাসপাতাল, ক্লিনিক ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোয় এসবের প্রকট ঘাটতি রয়েছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও জাতিসংঘের পানিবিষয়ক সংস্থা ইউএন ওয়াটার বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোয় নিরাপদ পানি, স্যানিটেশন ও হাইজিনের দিকে নিয়মিত দৃষ্টি রাখে। গত বৃহস্পতিবার তারা এ বিষয়ে ২০১৯ সালের বেসলাইন প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সংক্ষেপে ‘ওয়াশ’ নামে এই প্রতিবেদনের তথ্য বিবেচনায় নিলে বোঝা সহজ হবে, আমাদের স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোর এসব ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকার কারণ কী। দেখা যাচ্ছে, এই খাতে বাংলাদেশে বার্ষিক মাথাপিছু ব্যয় হয় ৫৬০ টাকা। এর মধ্যে ৪০০ টাকা আসে সরকারি বরাদ্দ থেকে, বাকি ১৬০ টাকা মানুষ খরচ করে নিজের পকেট থেকে। এই খাতে বাংলাদেশের মোট বার্ষিক বরাদ্দ ৬ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। এটাকে ওই প্রতিবেদনে অর্থায়নের ঘাটতি বলে মন্তব্য করা হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ায় নেপাল, শ্রীলঙ্কায় এই খাতে বরাদ্দ বাংলাদেশের তুলনায় অনেক বেশি (বাংলাদেশে ৫ ডলার, নেপালে ১২ ডলার, শ্রীলঙ্কায় ১৮ ডলার)। সুতরাং আমাদের এ খাতে অর্থ বরাদ্দ অবশ্যই আরও বাড়াতে হবে।

তবে শুধু অর্থ বরাদ্দ বাড়ালেই চলবে না, সে অর্থের সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টের স্বাস্থ্য–সম্পর্কিত বৈশ্বিক লক্ষ্যমাত্রায় শামিল হতে হলে আমাদের অবশ্যই এসব দিকে মনোযোগ বাড়াতে হবে। তার আগে নিজেদের জন্য একটি জাতীয় লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করতে হবে।

সূত্রঃ প্রথম আলো

About Post Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *