দেহকোষে জিনের গঠন বিন্যাস পরীক্ষা বা জিনোম সিকোয়েন্সিং-এর ব্যয় যত কমে আসছে এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স দিয়ে নতুন উপাত্ত বিশ্লেষণ যত সহজ হচ্ছে, তার ওপর ভিত্তি করে শুধুমাত্র আপনার জন্য বিশেষভাবে তৈরি ওষুধ তৈরির দিনটিও এখন আর খুব একটা দূরে নয়। আইসল্যান্ডের মোট জনসংখ্যার অর্ধেক মানুষের জিনের গঠন বিন্যাস এবং বিশ্লেষণ সম্পন্ন হয়েছে। ডিকোড জেনেটিক্স-এর মত বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠানে প্রায় ৬০০ মার্কিন ডলার ব্যয় করে হাজার হাজার মানুষ তাদের জিন গঠন বিন্যাস জেনে নিচ্ছেন। জেনে নিচ্ছেন তারা ভবিষ্যতে কোন্ কোন্ রোগের শিকার হতে পারেন।
“এমআরআই স্ক্যানের তুলনায় এই খরচ খুব একটা বেশি না,” বলছেন ডিকোড জেনেটিক্স-এর প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কারি স্টেফানসন।
সাধারণ মানুষের অসুখ-বিসুখ সম্পর্কে আগাম জানাই শুধু এ ধরনের প্রকল্পের উদ্দেশ্য নয়। পাশাপাশি কোন ব্যক্তির নির্দিষ্ট জিন গঠনের ওপর ভিত্তি করে ভবিষ্যতে শুধুমাত্র ঐ ব্যক্তির জন্য কীভাবে ওষুধ তৈরি করা যায়, তাও জানা সম্ভব হবে।
যেমন, কোন কোন মানুষের হজমশক্তি অন্যদের চেয়ে বেশি। ফলে তাদের জন্য সেই ধরনের ওষুধ তৈরি করা সম্ভব হবে বা তাদেরকে সেই ধরনের চিকিৎসা দেয়াও সম্ভব হবে। কারও বিশেষ কোন রোগের ঝুঁকি থাকলে তাদের জীবনযাত্রার পদ্ধতি পরিবর্তন করে কীভাবে সেই ঝুঁকি কমানো যায়, জিনোম সিকোয়েন্সিং করে সেটাও জানা যাবে।
“এই বিষয়ে যে বিপুল তথ্য আমাদের হাতে আসছে তা বিশ্লেষণ করার জন্য আমরা আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স প্রযুক্তি ব্যবহার করছি,” বলছেন মি. স্টেফানসন, “আর এসব উপাত্ত বিশ্লেষণ করে আমরা জানতে পারছি মানুষে-মানুষে দেহগত তফাৎগুলো কোথায়, নানা ধরনের অসুখের প্রকারভেদগুলো কী এবং কীভাবে ভিন্ন ভিন্নভাবে মানুষের চিকিৎসা দেয়া যায়।”
মানব দেহের প্রথম জিনোম সিকোয়েন্সিং করতে সময় লেগেছিল ১৩ বছর এবং ব্যয় হয়েছিল ২৭০ কোটি ডলার। কিন্তু এখন প্রযুক্তি উন্নত হওয়ার সাথে সাথে ডিএনএ বিশ্লেষণের খরচ অনেক কমে গেছে। মানুষের জিন বিন্যাসের তথ্য মজুদ রাখার জন্য সারা বিশ্বজুড়ে এখন গড়ে তোলা হচ্ছে ‘বায়োব্যাংক’। যেমন ধরুন, উত্তর ইয়োরোপের ছোট্ট একটি দেশ এস্তোনিয়া। সেখানকার নাগরিকদের স্বেচ্ছায় তাদের ডিএনএ নমুনা জমা দেয়ার জন্য উৎসাহ দেয়া হচ্ছে। সেখানে এসএনপি অ্যারে নামে পরিচিত স্বল্পমূল্যের এক পরীক্ষার মাধ্যমে সেই তথ্য বিশ্লেষণ করা হচ্ছে বলে জানালেন টারটু বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্সটিটিউট অফ জেনোমিক্স-এর বায়োব্যাংক প্রধান অধ্যাপক আন্ড্রেয়াস মেটস্পালু। মাথাপিছু এই পরীক্ষার ব্যয় মাত্র ৫০ ইউরো।
নানা ধরনের রোগের কারণ যে সাত লক্ষ জিন মিউটেশন, তার সাথে এসব লোকের দেহকোষ থেকে পাওয়া তথ্য যাচাই করা হয়। এবং ঐ পরীক্ষায় যারা অংশগ্রহণ করেছেন, এই প্রথমবারের মতো তাদেরকে পরীক্ষার ফলাফল জানানো হচ্ছে।
“সব ধরনের জেনেটিক মিল-অমিল যাচাই করার সময় সেখান থেকে এত নতুন তথ্য বেরিয়ে এসেছে যে আমাদের মনে হয়েছে এসব তথ্য কোন মানুষ চাইলে তার চিকিৎসার জন্যও ব্যবহার করতে পারেন,” বলছেন ঐ ইন্সটিটিউটের ফার্মাকোজেনোমিক্স বিভাগের দলনেতা ও উপপরিচালক অধ্যাপক লিলি মিলানি।
“যেমন ধরুন,কোন্ জিনের কাঠামো পরিবর্তনের ফলে রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে সেটা এই পরীক্ষা থেকে জানা যায়। আবার স্তনের ক্যান্সারের জন্য যে বিশেষ জিন মিউটেশন দায়ী, এটা থেকে সে সম্পর্কেও আগাম ধারণা পাওয়া সম্ভব।”
উদাহরণ দিয়ে অধ্যাপক মিলানি ব্যাখ্যা করলেন, ভবিষ্যতে হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কম না বেশি, কিংবা কারও টাইপ-টু ডায়াবেটিস হবে কি না, তা নির্ভর করে ঐ ব্যক্তির জিনের গঠন বিন্যাস, রোগ প্রবণতা এবং খাবার ও শরীরচর্চা ইত্যাদিসহ ঐ লোকের সার্বিক জীবনযাত্রার মানের ওপর। তাই এই ধরনের তথ্য জানানোর জন্য যথেষ্ট সতর্কতার প্রয়োজন রয়েছে। ভবিষ্যতে খুবই মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হতে যাচ্ছেন, এই আগাম খবরে যে কেউই খুবই বিচলিত হয়ে পড়বেন। এস্তোনিয়ায় যখন কাউকে তার ভবিষ্যৎ রোগের সম্ভাবনার কথা জানানো হয় তখন তাকে একটি নতুন ফর্মে সই করে সম্মতি দিতে হয় যে এই ফলাফল সম্পর্কে তিনি অবহিত। এরপর তার রক্তের দ্বিতীয় একটি নমুনা সংগ্রহ করে দ্বিতীয়বারের মতো পরীক্ষা চালানো হয়। উদ্দেশ্য দুটি ফলাফল যাচাই করে দেখা। এরপর বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের সাথে অ্যাপয়েন্টমেন্ট, কাউন্সেলিং ইত্যাদির ব্যবস্থা করা হয়। পাশাপাশি, এই দু:সংবাদ জানানোর জন্য পরিবারের সদস্যদের প্রতিও চিঠি লেখা হয়।
“এস্তোনিয়ায় যেটা একেবারেই অনন্য তা হলো এসব ফলাফল আমরা রোগীদের জানানো শুরু করেছি। যাদের স্তনে ক্যান্সার হবে কিংবা পরিবার সূত্রে যাদের রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা ভবিষ্যতে বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, এই ধরনের ফলাফল আমরা ক্লিনিকগুলোর সহায়তায় রোগীদের জানিয়ে দিচ্ছি,” বলছেন অধ্যাপক মিলানি।
“তবে এই ব্যাপারে আমরা খুবই সতর্ক এবং তথ্য প্রদানের ক্ষেত্রে আমরা খুবই রক্ষণশীল।”
কিন্তু সারা বিশ্বে জিন বিন্যাস পরীক্ষা যতই বাড়ছে, ততই গুরুত্বপূর্ণ একটি সমস্যা সামনে চলে আসছে। বেশিরভাগ পরীক্ষাই এখন চলছে এমন সব মানুষের ওপর যাদের জন্ম ইয়োরোপীয় পরিবারে।
যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল হিউম্যান জিনোম রিসার্চ-এর একজন পরিচালক ড. লুসিয়া হিনডর্ফ বলছেন, “আমরা যদি একই ধরনের জনগোষ্ঠীর ওপর বেশি নজর দেই, কিংবা যাদের সম্পর্কে তথ্য আগেই জোগাড় করা হয়েছে তাদের দিকেই বেশি মনোযোগ দেই, তাহলে স্বাস্থ্য সংক্রান্ত যেসব উপাত্ত রয়েছে তার মধ্য থেকে তারতম্যগুলো খুঁজে বের করা কঠিন হয়ে পড়বে।”
“আমরা এমন সব প্রমাণ পেয়েছি যাতে দেখা যাচ্ছে আপনি যদি তথ্য ভাণ্ডারে ৫০ হাজার অ-ইয়োরোপীয় লোকের বদলে ৫০ হাজার ইয়োরোপীয় লোকের উপাত্ত যোগ করেন তাহলে তাহলে উপাত্তের মান বদলে যায়। কিন্তু আপনি যদি ৫০ হাজার অ-ইয়োরোপীয় লোকের তথ্য যোগ করেন তাহলে অনেক বেশি তারতম্য খুঁজে পাওয়া যায়।” অর্থাৎ বেশি সংখ্যায় রোগ সনাক্ত করা যায়।
জিনোমিক্স এবং রোগতত্ত্বকে ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্রে নতুন এক গবেষণা প্রকল্প চালু হয়েছে। এর আওতায় ড. হিনডর্ফ এবং তার সহযোগীরা প্রায় ৫০,০০০ আমেরিকান-আফ্রিকান, লাতিনো, এশীয় এবং নেটিভ হাওয়াইয়ান ও নেটিভ আমেরিকানের ডিএনএ তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে।
এ থেকে তারা রক্তচাপ, টাইপ-টু ডায়াবেটিস, ধূমপান এবং জটিল কিডনি রোগের সাথে সম্পর্কিত ২৭টি নতুন ধরনের জিনগত সমস্যা আবিষ্কার করেছেন। হাওয়াই দ্বীপের আদি বাসিন্দাদের কাছ থেকে ডিএনএ উপাত্ত বিশ্লেষণ করে তারা দেখেছেন প্রতিদিন যে ক’টা সিগারেট খাওয়া হচ্ছে তার সঙ্গে জিনোম ভ্যারিয়েশনের একটা নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। অন্য কোন জনগোষ্ঠীতে এই ব্যাপারটা লক্ষ্য করা যায়নি।
একইভাবে এই গবেষণা দলটি দেখেছে, আফ্রিকান-আমেরিকানদের রক্তের হিমোগ্লোবিনে যে গ্লুকোজ থাকে তার সাথে হিমোগ্লোবিন জিনের একটা তফাৎ রয়েছে। সিকেল সেল অ্যানিমিয়ার জন্য এই জিন দায়ী।
এসব গবেষণার ফলে ব্যক্তি-বিশেষের প্রয়োজনকে সামনে রেখে কারও জন্য বিশেষভাবে ওষুধ তৈরির কাজটা ভবিষ্যতে সহজ হয়ে যাবে বলে বিজ্ঞানীরা মনে করছেন।
এমন একটা সময় আসবে যখন শিশুদের জন্মের সময় তাদের জিনোম সিকোয়েন্স করা হবে। এস্তোনিয়ার অধ্যাপক লিলি মিলানি বলছেন, এস্তোনিয়ার স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা এরই মধ্যে এই প্রস্তাব দিয়ে রেখেছেন।
“আমার বিশ্বাস, জিনের গঠন বিন্যাসের ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে (শিশুর) জন্মের সময়ই এই বিশ্লেষণ করা সম্ভব হবে। ফলে তার ভবিষ্যৎ রোগ-বালাই প্রতিরোধের চিকিৎসা প্রদানও সহজ হবে,” তিনি বলছেন, “আমরা যদি পারি, তাহলে সেটা করবো নাই বা কেন?”
সূত্র : বিবিসি বাংলা