মিরপুরের হাসপাতাল গুলোতে সিটের সঙ্কট , কিটস না থাকায় ডেঙ্গু পরীক্ষা ছাড়াই পাঠানো হচ্ছে ফেরত

‘একটা সিটের জন্য সকাল থেকে বসে আছি। আমার রোগী এখন ভর্তি হবে। কারও কথা শুনব না। দেখি কে অন্য রোগী ভর্তি করায়। আপনারা আমার অনেক পরে হাসপাতালে এসেছেন।’ সোমবার মিরপুরের ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালের অভ্যর্থনা কক্ষে এক যুবক এভাবেই নিজের দাবি প্রকাশ করছিলেন। এর জবাবে এক নারী বলছিলেন, ‘আপনি ভুল বলছেন। আমরা অনেক আগে থেকেই সিটের জন্য হাসপাতালে যোগাযোগ করেছি। অপেক্ষমাণ সিরিয়ালেও নাম লিখিয়েছি। আমার স্বামীর প্লাটিলেট ২৭ হাজারে নেমে গেছে। চিৎকার না করে মানবিকভাবে বিষয়টি দেখেন।’ দু’জনের এ রকম পাল্টাপাল্টি বক্তব্যে ওই হাসপাতালের পরিবেশ কিছু সময়ের জন্য বেশ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। ওই নারীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, তার নাম আফরোজা রহমান। তার স্বামী আনিসুর রহমান বুলবুল এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত। মাঝখানে কয়েক দিন কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। সেখান থেকে ছাড়া পেয়ে বাসায় ফিরে যান। তবে জ্বর আবার বাড়তে থাকায় এবং প্লাটিলেট কমতে শুরু করায় বুলবুলকে নিয়ে আবার হাসপাতালে ছোটাছুটি শুরু করছেন তার স্ত্রী। অন্য পক্ষের যুবকটির নাম মুরাদ হোসেন। ডেঙ্গু আক্রান্ত ভাই সালমান কার্তিককে নিয়ে তিন দিন ধরে বিভিন্ন হাসপাতালে দৌড়ঝাঁপ করেও সিট না পেয়ে মাথা ঠিক রাখতে পারছিলেন না।

ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ও তাদের স্বজনের মধ্যে হাসপাতালে সিট পাওয়া না পাওয়া নিয়ে এমন দৃশ্যের বাইরে অন্য চিত্রও দেখা গেল। গতকাল রাজধানীর মিরপুরের তিনটি হাসপাতাল, দুটি ডায়াগনস্টিক সেন্টার ঘুরে রোগী ও উপস্থিত স্বজনের নানা ক্ষোভ ও অভিযোগের কথা জানা যায়। ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে কথা হয় সোহাগ নামে এক যুবকের সঙ্গে। তিনি ফুসিয়া ইলেকট্রনিক্স নামের একটি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। জ্বর নিয়ে হাসপাতালে এসেছেন ডেঙ্গুর পরীক্ষা করাতে। এই প্রতিবেদককে সোহাগ বললেন, ‘প্রতিদিন এই যে এত মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে, এর দায়ভার কে নেবে। একদিকে মানুষ মরছে, আর কেউ কেউ আসল কাজ না করে লম্বা জামা-কাপড় পরার পরামর্শ দিয়ে বেড়াচ্ছেন। কাজের কাজ তো কিছু হচ্ছে না।’ সোহাগের প্রশ্ন- একটি বাসযোগ্য শহর নিশ্চিত করার দায়িত্ব তাহলে কার। সোহাগের মতো আরও অনেক ভুক্তভোগী মানুষের হৃদয় থেকেই ঝরছিল ক্ষোভের রক্তক্ষরণ। গায়ের জ্বরের উত্তাপের চেয়ে সেই ক্ষোভের দহন কোনো অংশে কম নয়! কেউ কেউ বলছিলেন, ডেঙ্গু তাদের ঈদের আনন্দও কেড়ে নিয়েছে। কবে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরতে পারবেন, আদৌ পারবেন কি-না সেটা নিয়েই এখন বড় দুশ্চিন্তা। মধ্যবিত্ত আর নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের অনেকে চিকিৎসার খরচ কুলাতে না পেরে অথৈ সাগরে পড়ে গেছেন।

ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালের ফ্রন্ট ডেস্ক অফিসার মো. রফিক বলেন, ৬৮ শয্যার ওই হাসপাতালের ৩০টি বেডে ডেঙ্গু রোগী ভর্তি রয়েছে। প্রতিদিন গড়ে একশ’ জন রোগীর জন্য বেডের চাহিদা রয়েছে। তারা ৮-১০ জনকে বেড দিতে পারছেন। বাকিদের ফেরত পাঠাতে হচ্ছে। 

মিরপুরের ১০ নম্বর সেকশনের বাসিন্দা এবিএম সাদিকুল ইসলাম সুমন সানটেক এনার্জি লিমিটেডের ম্যানেজার হিসেবে কর্মরত। এলাকার আলোক হাসপাতালের ‘অনুসন্ধান’ কাউন্টারে গিয়ে খোঁজ নিচ্ছিলেন- সেখানে ডেঙ্গুর পরীক্ষা হচ্ছে কি-না। তাকে জানানো হয়, কিটস না থাকায় তিন দিন ধরে আলোক হাসপাতালে ডেঙ্গুর পরীক্ষা বন্ধ আছে। সংবাদকর্মী পরিচয় পাওয়ার পর সুমনের কণ্ঠে ফুটে ওঠে তীব্র ক্ষোভ। তিনি বলেন, তীব্র জ্বরে আক্রান্ত স্ত্রীকে নিয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে ঘুরছেন। কিটের অভাবে পরীক্ষা করাতে পারছেন না। চারদিকে আতঙ্ক। অথচ কোথাও মশার ওষুধ ছিটাতে দেখা যাচ্ছে না। এসব অনিয়ম কতদিন চলবে। 

আলোক হাসপাতালের পাবলিক রিলেশন্স অফিসার মো. আলী বলেন, কিটস না থাকায় শত শত রোগীকে ডেঙ্গুর পরীক্ষা না করেই ফেরত পাঠাতে হচ্ছে। কিট সংগ্রহের চেষ্টা চলছে।

মিরপুরের পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মৃণাল রায় বলেন, তাদের প্রতিষ্ঠানে ডেঙ্গু শনাক্ত করার কিট রয়েছে। তবে প্রয়োজনীয় ডিভাইস না থাকায় আইজিএম (ইমিউনোগ্লোবিউলিন্স) ও আইজিজি (ইমিউনোগ্লোবিউন্সি-জি) পরীক্ষা বন্ধ রয়েছে। ডেঙ্গু রোগীদের ক্ষেত্রে ওই দুটি পরীক্ষাও জরুরি। 

ডা. এম আর খান শিশু হাসপাতালের চিত্র :মিরপুর ২ নম্বরে ডা. এম আর খান শিশু হাসপাতালে চোখে পড়ে শত শত অভিভাবকের দীর্ঘ লাইন। অধিকাংশই এসেছেন বাচ্চার ডেঙ্গুর পরীক্ষা করাতে। হাসপাতালটির পরিচালক (একাডেমিক) ও শিশু বিভাগীয় প্রধান ডা. অধ্যাপক ফজলুল হক জানালেন, ২৫০ শয্যার এই হাসপাতালে ৩০-৪০ শতাংশ ডেঙ্গু রোগী। প্রতিদিন ৯০০-১৩০০ শিশু হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়। তার মধ্যে ৪০-৫০ শতাংশকে ডেঙ্গুর পরীক্ষা দিতে হচ্ছে। চলমান পরিস্থিতি সামলাতে হাসপাতালে বেড সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। তারপরও বেড সংকটের কারণে ডেঙ্গু আক্রান্ত অনেক শিশুকে ফেরত পাঠাতে বাধ্য হচ্ছেন তারা। হাসপাতালের চার তলার ৪১৬ নম্বর বেডে ভর্তি আছে হাসিবুর রহমান শুভ। ছয় দিন আগে তাকে ভর্তি করা হয়েছে। তখন তার প্লাটিলেট ছিল ২ লাখ ৯০ হাজার। সোমবার তা ৭৫ হাজারে নেমে গেছে। শুভর বাবা হাবিবুর রহমান জানান, হাসিখুশি ছেলেটির মুখটা হঠাৎ কেমন অচেনা হয়ে গেছে। কবে ছেলে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরবে সেই দুশ্চিন্তায় রয়েছে পরিবারের সবাই। ওই হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ভর্তি আছে ১০ মাস বয়সের ছোট্ট খাদিজা। মা জান্নাত আরা তার শরীরে তেল মেখে দিচ্ছিলেন। তিনি জানালেন, গত রোববার খাদিজাকে ভর্তি করা হয়। তখন প্লাটিলেট ছিল ২ লাখ ৫০ হাজার। সোমবার তা নেমে দাঁড়িয়েছে ১ লাখে। একই হাসপাতালের ডেঙ্গুর আলাদা ওয়ার্ডে ভর্তি আছে মনিপুর স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী মৌনতা। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে স্বজনের সঙ্গে দুষ্টুমিমাখা হাসিতে মেতে উঠছিল ক্ষণে ক্ষণে। অসুস্থ শরীরেই তারই এমন উচ্ছ্বলতার আবেশ ছড়িয়ে পড়ে পুরো ওয়ার্ডে। কেমন আছো- জানতে চাইলে মৌনতা বলে- ‘খুব ভালো’। 

ডা. ফজলুল হক জানালেন, ডেঙ্গু রোগীর শরীরে পানিশূন্যতা দেখা দেওয়ার পাশাপাশি হেমাটোক্রিট কমতে থাকে। হেমাটোক্রিট বেসলাইন থেকে ২০ শতাংশ বেড়ে গেলে ধরে নেওয়া হয় আক্রান্ত রোগীর শরীরে প্লাজমা লস হয়েছে। তখন স্যালাইন দেওয়া শুরু হয়। দ্রুত দুই দফায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার পরও যখন দেখা যায় রোগীর অবস্থার উন্নতি হয়নি তখন ধরে নেওয়া হয় তার ‘ইন্টারনাল ব্লিডিং’ হয়েছে। 

তিনি আরও বলেন, সাধারণত প্লাটিলেট ১০-১৫ হাজারে নেমে এলে রক্ত দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। তবে আমাদের অভিজ্ঞতা হচ্ছে, কারও প্লাটিলেট ৫০ হাজারে নেমে এলে রোগী ও তার স্বজনরা আতঙ্কগ্রস্ত হন। এমন ক্ষেত্রে ওই রোগীকে চিকিৎসকরা রক্ত দেওয়ার কথা বলে থাকেন। 

সূত্রঃ সমকাল

About Post Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *