মশা নিধনে সিটি করপোরেশন আগে থেকে পদক্ষেপ নেয়নি। এখন ডেঙ্গুর বিস্তার বন্ধ করতে হলে মশা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। জাতীয় নির্দেশিকা অনুসরণ করে চিকিৎসা করলে ডেঙ্গুতে মৃত্যু কমানো সম্ভব হবে। সম্মিলিত প্রয়াস ছাড়া পরিস্থিতি মোকাবিলা করা যাবে না।
‘ডেঙ্গু পরিস্থিতিতে জরুরি করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে শিক্ষাবিদ, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও কীটতত্ত্ববিদেরা এসব কথা বলেছেন। রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এই বৈঠক আয়োজনে সহযোগিতা করে ল্যাবএইড।
মশা নিধনে সিটি করপোরেশন কী করেছে, তার বর্ণনা দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তা বলেছেন, ডেঙ্গুর বর্তমান পরিস্থিতি সামাল দিতে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও নাগরিক সমাজকেও এগিয়ে আসতে হবে। ভুক্তভোগী পরিবার চলমান কষ্টের কথা শুনিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, কোনো জ্বরকেই অবহেলা করা যাবে না, জ্বর হলেই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে, ডেঙ্গু শনাক্ত হওয়া প্রত্যেক রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করার দরকার নেই। আর ডেঙ্গু ব্যবস্থাপনায় প্রত্যেক চিকিৎসককে জাতীয় নির্দেশনা মেনে চিকিৎসা দিতে হবে।
ডেঙ্গুর রাজ্য
সবাই মিলে ডেঙ্গু প্রতিরোধে কাজ না করলে ঢাকা ডেঙ্গুর রাজ্যে পরিণত হয়ে যেতে পারে—বক্তব্যের শেষ দিকে এমনই মন্তব্য করেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। গোলটেবিল বৈঠকে সবার শেষে বক্তব্য রেখেছিলেন তিনি। ২০০০ সালে ডেঙ্গুর প্রবল প্রকোপের সময় তিনি ও তাঁর এক হাজার ছাত্র ঢাকা শহরে কী কী সামাজিক উদ্যোগ নিয়েছিলেন, তার বর্ণনা দেন।
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেন, সিটি করপোরেশন চিরকালের মতোই নীরব। মশা মারা ছাড়া সিটি করপোরেশনের কাজ তো কিছুই না। কিন্তু এবারও সিটি করপোরেশন মশা নিধনে আগে থেকে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। তিনি বলেন, ‘আমরা ট্যাক্স দিই। আমরা এটা প্রত্যাশা করি।’
অনুষ্ঠানে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম এ শরীফ উপস্থিত ছিলেন। তিনি বলেন, মার্চ মাস থেকে দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নগরবাসীকে সচেতন করার কাজ শুরু করে। বিএসএমএমইউতে বৈজ্ঞানিক সেমিনারের পাশাপাশি নগরে মাইকিং করা হয়েছে, প্রচারপত্র বিতরণ করা হয়েছে। লার্ভা ও মশা নিধনে নিয়মিত কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা ছাড়াও সর্বাত্মক অভিযানও (ক্রাশ প্রোগ্রাম) চালানো হয়েছে।
এম এ শরীফ বলেন, সিটি করপোরেশনের নিজস্ব ল্যাবরেটরি নেই। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের প্ল্যান্ট প্রোটেকশন উইং এবং রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) ল্যাবরেটরিতে তাঁরা ওষুধের মান পরীক্ষা করেন। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) মশার ওষুধের একটি উপাদান (পারমেথ্রিন) পরীক্ষা করে ওষুধকে অকার্যকর বলেছে। কিন্তু ওষুধে আরও উপাদান থাকে। আইসিডিডিআরবি পুরো ওষুধের কার্যকারিতা নিয়ে কোনো পরীক্ষা করেনি। সিটি করপোরেশনের একার পক্ষে পরিস্থিতি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব নয় মন্তব্য করে প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা বলেন, নতুন ওষুধ দ্রুততার সঙ্গে আনার সব ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার কর্মসূচি ব্যবস্থাপক (ম্যালেরিয়া ও ডেঙ্গু) এম এম আক্তারুজ্জামান স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গৃহীত পদক্ষেপের বর্ণনা দেন। তিনি বলেন, দুই সিটি করপোরেশনের ১০০টি স্থানে তাঁরা বছরে তিনবার মশা জরিপ করেন। বর্ষার শুরুতে তাঁরা একবার জরিপ করেছিলেন। দ্বিতীয় পর্যায়ের জরিপ শেষ হয়েছে গত শনিবার। প্রাথমিক ফলাফলে দেখা গেছে, মশা প্রায় ছয় গুণ বেড়েছে। তিনি বলেন, জাতীয় নির্দেশিকা অনুসরণ করা হচ্ছে কি না, তা দেখার জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ১০টি পরিদর্শক দল গঠন করেছে। তারা সরকারি ও বেসরকারি সব হাসপাতাল পরিদর্শন করবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আরেকজন প্রতিনিধি পুষ্টি কর্মসূচির লাইন ডিরেক্টর মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, পরিস্থিতি মোকাবিলায় একসঙ্গে কাজ করতে হবে। সরকারি–বেসরকারি হাসপাতালে, চিকিৎসকের ব্যক্তিগত চেম্বারে এবং ওষুধের দোকান থেকে কত মানুষ চিকিৎসা নিচ্ছে, তার সঠিক তথ্য থাকা জরুরি।
ব্যবস্থাপনা ও চিকিৎসা
গোলটেবিল বৈঠকে চিকিৎসকেরা রোগ ব্যবস্থাপনা ও চিকিৎসা নিয়ে কথা বলেছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) মেডিসিন অনুষদের ডিন অধ্যাপক এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, মানুষ আতঙ্কগ্রস্ত। অনেকে মনে করছে, ডেঙ্গু মানে মৃত্যু। কিন্তু না। সঠিক চিকিৎসা হলে ১০০ শতাংশ রোগী ভালো হয়। তিনি বলেন, ঝুঁকি নেওয়া যাবে না, যে জ্বরই হোক চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। একই কথা আরও একাধিক চিকিৎসক বলেছেন।
অনুষ্ঠানের শুরুতে ভাইরোলজিস্ট ও বিএসএমএমইউর সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক নজরুল ইসলাম কোন পর্যায়ে এবং কেন এই রোগ তীব্র হয় তার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দেন। তিনি বলেন, ডেঙ্গুর চার ধরনের ভাইরাস। একধরনের ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পর শরীরে ইমিউনিটি বা নিরাপত্তা তৈরি হয়। কিন্তু বাকি তিনটির যেকোনো একটিতে আক্রান্ত হলে পরিস্থিতি জটিল ও তীব্র হতে পারে।
ডেঙ্গু চিকিৎসার জাতীয় নির্দেশিকা তৈরির সঙ্গে জড়িত ছিলেন ল্যাবএইড কার্ডিয়াক হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক এফ এম সিদ্দিকী। আলোচনায় অংশ নিয়ে তিনি বলেন, ব্যবস্থাপনা ভালো হলে ৫-৬ দিনে রোগী সুস্থ হয়ে যায়। জ্বর শুরু হলে, জ্বর শুরু হওয়ার পর এবং জ্বর ভালো হওয়ার পর প্রতিটি স্তরেই তীক্ষ্ণ নজরদারি দরকার। তিনি বলেন, অনেকে ডেঙ্গু জ্বরে বেশি পানি খাওয়ার কথা বলেন। কিন্তু প্রয়োজনের অতিরিক্ত পানি ফুসফুসের সমস্যা তৈরি করতে পারে।
নবজাতক ও শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মো. আবদুল মান্নান বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে দেশের প্রত্যেক সচেতন নাগরিক শিশুদের নিয়ে উদ্বিগ্ন। তবে জ্বরে আক্রান্ত সব শিশু বা সব রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করার দরকার নেই। ডেঙ্গুর জন্য চিহ্নিত বিপজ্জনক লক্ষণ থাকলেই চিকিৎসক তাকে ভর্তি করাবেন। তিনি আরও বলেন, ডেঙ্গু প্রতিরোধে কার্যকর কোনো টিকা এখনো পাওয়া যাচ্ছে না। সম্ভাব্য টিকাগুলো এখনো পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর্যায়ে আছে।
রক্ত ও প্লাটিলেট (অণুচক্রিকা) নিয়ে বিশদ আলোচনা করেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা। তাঁরা বলেন, ডেঙ্গু আক্রান্ত হলেই বাড়তি প্লাটিলেট দিতে হবে, এই ধারণা ভুল। তবে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের হেমাটোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক এম এ খান বলেন, প্লাটিলেট দেওয়ার জন্য লোক প্রস্তুত করে রাখতে হবে। কারণ, যেকোনো সময় দরকার হতে পারে।
ডেঙ্গুতে এবার এ পর্যন্ত ৫ জন চিকিৎসক মারা গেছেন উল্লেখ করে স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্য বিভাগের প্রধান নওজিয়া ইয়াসমিন বলেন, কোনো ডেঙ্গু রোগী যেন দোকান থেকে নিজে ব্যবস্থাপত্র ছাড়া ওষুধ কিনতে না পারে, সে ব্যাপারে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।
এক শিশু ও এক কীটতত্ত্ববিদ
অনুষ্ঠানে এসেছিল রুজাইনা নামের ১০ বছরের এক কন্যাশিশু। ওর ডেঙ্গু হয়েছিল। হাসপাতালে ছিল। এখন সুস্থ। অনেক চেষ্টা করেও তাকে দিয়ে তার কষ্টের কথা বলানো যায়নি। তবে রুজাইনার মা সংগীতা রহমান বলেন, ‘আমাদের এখন খাবারের খরচের চেয়ে মশার পেছনে বেশি খরচ হচ্ছে। মেয়েকে হাসপাতাল থেকে বাড়ি আনার পরও ভয় কাটেনি। মশা মারার জন্য কয়েল, ওষুধসহ নানা ধরনের জিনিস ব্যবহার করছেন। রাতে তাঁদের শ্বাসকষ্ট হয়।
এ মুহূর্তের করণীয় নিয়ে বক্তব্য দেন কীটতত্ত্ববিদ মঞ্জুর চৌধুরী। বলেন, ডেঙ্গু রোগীর কাছ থেকে রক্ত খেয়ে এখন ডেঙ্গুর ভাইরাস ছড়াচ্ছে এডিস মশা। মশা যেন কামড়াতে না পারে, সে জন্য রোগীকে মশারির মধ্যে রাখা ভালো। এতে রোগীর আত্মীয়, চিকিৎসক, নার্স ও হাসপাতালের অন্যদের ঝুঁকি কমবে। তিনি আরও বলেন, বাড়িতে থাকা রোগীকেও মশারির মধ্যে রাখতে হবে। প্রত্যেককে ব্যক্তিগত নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিতে হবে। যেমন সম্ভাব্য সময়ে বা জায়গায় হাফপ্যান্টের পরিবর্তে ফুলপ্যান্ট বা মোজা পরে থাকতে হবে।’
সুত্র ঃ প্রথম আলো