সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ

নিখিল মানখিন ॥ সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা (ইউএইচসি) অর্জনে পিছিয়ে পড়ছে বাংলাদেশ। জোড়াতালি দেয়া কার্যক্রমে তুলনামূলক চিত্রে এই অর্জন ৫০ শতাংশের নিচে। সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা অর্জনে বাংলাদেশকে অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা বাস্তবায়নে সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ। দেশের ক্ষুদ্র আয়তন ও সীমিত সম্পদের বিপরীতে রয়েছে জনসংখ্যার বিস্ফোরণ। এই কাঠামোর বিভিন্ন উপাদানের মধ্যে নেই কোন সমন্বয়। ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে রয়েছে আকাশচুম্বী বৈষম্য। সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর বিনামূল্যের নামে বিদ্যমান সেবার মান প্রশ্নবিদ্ধ। আর বেসরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর উচ্চমূল্যের স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাসেবা সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। স্বাস্থ্য বীমা শুরু হলেও তা দেশের মাত্র একটি জেলার তিনটি থানায় পাইলট প্রকল্প হিসেবে চালু রয়েছে। পূর্ণ আস্থা না থাকায় প্রতি বছর প্রায় দুই লাখ বাংলাদেশী রোগী উন্নত চিকিৎসা গ্রহণ করতে বিদেশে পাড়ি জমান। সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষায় এসবই আমাদের অন্তরায়।

সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার মূল কথা হচ্ছে, সব মানুষ প্রয়োজনের সময় মানসম্পন্ন চিকিৎসাসেবা পাবে। চিকিৎসাসেবা নিতে গিয়ে কেউ দরিদ্র হয়ে পড়বে না। উদ্দেশ্য অর্জনে কৌশল হিসেবে বলা হয়েছে, স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধির পাশাপাশি অপচয় ও দুর্নীতি কমাতে হবে, স্বাস্থ্য বীমা মানুষকে সেবাপ্রাপ্তির নিশ্চয়তা দেবে।

ইউএইচসি সূচকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় পেছনের সারিতে বাংলাদেশ ॥ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের তথ্য প্রতিবেদন তুলে ধরে ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়নের (আইপিইউ) স্বাস্থ্য বিষয়ক কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডাঃ মোঃ হাবিবে মিল্লাত, এমপি জনকণ্ঠকে জানান, সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা সূচকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ১০টি দেশের মধ্যে সবচেয়ে পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ। জোড়াতালি দিয়ে যেসব কার্যক্রম চলছে তা মিলিয়েও তুলনামূলক চিত্রে অবস্থান ৫০ শতাংশের ওপরে উঠতে পারেনি। অন্যদিকে মানুষের চিকিৎসার জন্য নিজের পকেট থেকে সবচেয়ে বেশি যায় বাংলাদেশে, যা দেশের স্বাস্থ্য খাতের জন্য অশনিসংকেত। সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা সূচকে বাংলাদেশের অগ্রগতি ৫০ শতাংশ। অথচ এই সূচকে ভুটান ৭২, নেপাল ৬২, শ্রীলঙ্কা ৬৮, ইন্দোনেশিয়া ৬১, মালদ্বীপ ৭২, দক্ষিণ কোরিয়া ৭৮ ও থাইল্যান্ড সর্বোচ্চ ৮৮ শতাংশ অবস্থানে রয়েছে। এ ক্ষেত্রে কেবল বাংলাদেশের চেয়ে পিছিয়ে আছে তিমুর। যদিও ওই তিমুর আবার সবার চেয়ে এগিয়ে আছে চিকিৎসায় রাষ্ট্রের ব্যয়ের দিক থেকে। অর্থাৎ তিমুরে চিকিৎসার পেছনে ব্যক্তির পকেট থেকে ব্যয় হয় মাত্র ১০ শতাংশ। আর এ ক্ষেত্রে এই ১০ দেশের মধ্যে বাংলাদেশে ব্যক্তির পকেট থেকে খরচ হয় সর্বোচ্চ ৬৭ শতাংশ। এ ছাড়া থাইল্যান্ডে ১২, মালদ্বীপে ১৬, ভুটানে ২০, নেপালে ৬০, ভারতে ৬৫, ইন্দোনেশিয়ায় ৪৮ ও শ্রীলঙ্কায় ৩৮ শতাংশ ব্যয় হয় ব্যক্তির পকেট থেকে।

দেশের মানুষ স্বাস্থ্যের জন্য নিজের পকেট থেকে সবচেয়ে বেশি ব্যয় করে ॥ ২০১৭ সালে প্রকাশিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হেলথ ইকোনমিক্স ইউনিটের তৈরি ‘বাংলাদেশ ন্যাশনাল হেলথ এ্যাকাউন্টস ১৯৯৭-২০১৫’ প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশের স্বাস্থ্য খাতে যে অর্থ ব্যয় হয়, তার মাত্র ২৩ ভাগ বহন করে সরকার আর ৬৭ ভাগ ব্যয় করে ব্যক্তি নিজে। প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের মানুষ স্বাস্থ্যের জন্য নিজের পকেট থেকে সবচেয়ে বেশি ব্যয় করে। ২০১২ সালে মোট স্বাস্থ্য ব্যয়ের ৬৩ শতাংশ বহন করত ব্যক্তি নিজের পকেট থেকে। আর এখন তা বেড়ে ৬৭ শতাংশ হয়েছে। আর এনজিও ও দাতা সংস্থাগুলো বহন করছে ১০ শতাংশ। স্বাস্থ্য ব্যয় বাড়লেও সরকারী অংশের খরচ কমেছে।

স্বাস্থ্যবীমার কার্যক্রম কম ॥ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রোগীর সুরক্ষায় স্বাস্থ্য বীমা চালু থাকলেও বাংলাদেশে এখনও এ সেবা সফলভাবে চালু করা সম্ভব হয়নি। স্বাস্থ্যবীমা শুরু হলেও তা দেশের মাত্র একটি জেলার তিনটি থানায় পাইলট প্রকল্প হিসেবে চালু রয়েছে। সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা কার্যক্রম সম্প্রসারণে দেশের মানুষকে স্বাস্থ্যবীমায় আগ্রহী করতে নানা উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। জানা যায়, দেশে প্রচলিত প্রাইভেট ইনস্যুরেন্স কোম্পানিগুলোর ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবীমা খুব গ্রহণযোগ্য না হলেও গ্রুপ স্বাস্থ্যবীমা জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। তবে বহু প্রতিষ্ঠান এই গ্রুপ স্বাস্থ্যবীমা করছে। এর বাইরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, গ্রামীণ ব্যাংকসহ বেশকিছু প্রতিষ্ঠান নিজস্ব আঙ্গিকে স্বাস্থ্যবীমা চালু করেছে। অন্যদিকে কমিউনিটি পর্যায়ে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রসহ আরও কয়েকটি সংস্থা কাজ করছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সেবাপ্রাপ্তির নিশ্চয়তা থাকার পরও দেশের অধিকাংশ মানুষই স্বাস্থ্যসেবা পেতে বীমা করতে আগ্রহী নয়। তাছাড়া আগে টাকা দিয়ে পরে সেবা গ্রহণের মনোভাব না থাকা এবং একজনের টাকায় অন্যজনের চিকিৎসা এ বিষয়েও অনীহা রয়েছে। তাই স্বাস্থ্যবীমা নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না। পৃথিবীর উন্নত দেশ এবং কল্যাণ রাষ্ট্রগুলোয় মানুষের স্বাস্থ্য সেবা অনেকাংশে বীমার ওপর নির্ভরশীল। ফলে স্বাস্থ্যসেবা ব্যয় মেটাতে সেসব দেশের জনগণকে আর্থিক সমস্যায় পড়তে হয় না। কিন্তু স্বাস্থ্যসেবা পেতে বাংলাদেশের মানুষকে মোট স্বাস্থ্য ব্যয়ের ৬৭ ভাগ পকেট থেকে করতে হয়। স্বাস্থ্যসেবা পেতে বীমাতে অনাগ্রহের কারণে অধিকসংখ্যক মানুষকে সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার (ইউএইচসি) আওতায় আনা যাচ্ছে না। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) ১৭ উদ্দেশ্যের মধ্যে অন্যতম সবার জন্য সুস্বাস্থ্য। কারণ দেশের সব ধরনের উন্নয়নের স্থায়িত্বের জন্য সবার আগে প্রয়োজন জনগণের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা। এজন্য সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্মসূচীর এবং স্বাস্থ্যবীমার বিকল্প নেই। কিন্তু দেশের অধিকাংশ মানুষ স্বাস্থ্যবীমার প্রতি অনাগ্রহী। এই প্রেক্ষিতে দেশে স্বাস্থ্যবীমা নিশ্চিত করা সহজ নয়। এর জন্য সমন্বিত (সরকারী-বেসরকারী) উদ্যোগ প্রয়োজন। এদিকে ২০৩০ সালের মধ্যে এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের একটি বাধ্যবাধকতা

সরকারী হাসপতালে চিকিৎসাব্যয় ॥ স্বাস্থ্য অধিদফতর জানায়, নামমাত্র খরচে চিকিৎসাসেবা পাওয়া যায় সরকারী হাসপাতালে। অপারেশন, সিসিইউ, আইসিসিইউ ও ডায়ালাইসিস সেবার ক্ষেত্রে কোন টাকা নেয়া যাবে না। তবে বেশকিছু পরীক্ষা করাতে স্বল্প ফি নেয়া হয়। এক্ষেত্রেও সরকারী ফি বেসরকারী হাসপাতালের ফি’র তুলনায় অনেক গুণ কম। সরকারী হাসপাতালে করোনারি এনজিওগ্রামে ২ হাজার টাকা, সিটিস্ক্যানে ২ হাজার টাকা, এমআরআই ৩ হাজার টাকা, ইসিজি ৮০ টাকা, ইকোকার্ডিওগ্রাম ২০০ টাকা, এক্সরে ২০০ টাকা, আল্ট্রাসনোগ্রাম ৩০০ টাকা, কার্ডিয়াক ক্যাথ ২ হাজার টাকা, ইউরিন ৩০ টাকা এবং রক্তের হিমোগ্লোবিন, টোটাল কাউন্ট করাতে লাগে মাত্র ১০০ টাকা। সব হাসপাতালে ওষুধ ও অন্যান্য সামগ্রী বিনামূল্যে সরবরাহ করা হয়। এই মুহূর্তে কোন ঘাটতি নেই। কিন্তু বিনামূল্যের চিকিৎসায় ফি দিতে হয় সরকারী হাসপাতালে। জরুরী বিভাগ থেকে রোগীশয্যা পর্যন্ত পৌঁছার চিকিৎসা ব্যয় (ট্রলিম্যান ও শয্যা যোগানদাতা) লিখিত থাকে না। শয্যায় ওঠার পর চলে পরীক্ষা-নিরীক্ষার খেলা। প্রকৃতপক্ষে পরীক্ষা-নিরীক্ষার ক্ষেত্রে কোন ফ্রি নেই। ইউজার ফি আদায়ের নামে এখানে রোগীদের ফি প্রদানে বাধ্য করা হয়েছে। অনেক পরীক্ষা বাইরে গিয়ে করাতে হয়। উচ্চমূল্যের ওষুধ এবং চিকিৎসকদের প্রেসক্রিপশনে লেখা কোম্পানির ওষুধ সংশ্লিষ্ট হাসপাতালে পাওয়া না গেলেই রোগীদের বাইরে থেকে ওষুধ কিনতে হয়। শুধু চিকিৎসককে এবং রোগীর খাবারের ক্ষেত্রে কোন টাকা দিতে হয় না। তবে চুক্তিবদ্ধ বাইরের ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পরীক্ষার জন্য রোগী পাঠিয়ে সরকারী হাসপাতালে ফ্রি রোগী দেখার টাকা উঠিয়ে নেন অনেক চিকিৎসক। এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতে নিয়ে যেতে ট্রলিম্যানদের টাকা দিতে হয়। অধিকাংশ রোগীর ক্ষেত্রেই ফ্রি বলে কিছু নেই। টাকা ও তদ্বির না হলে ফ্রি পাওয়া যায় না। সার্জারি ও আইসিইউ রোগী হলে তো খরচের শেষ নেই। এভাবে পদে পদে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ খরচ মেটাতে গিয়ে সরকারী ফ্রি চিকিৎসা যেন সাধারণ মানুষের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়াচ্ছে! সরকারী স্বাস্থ্যসেবার একটি বড় অংশই জনগণকে বহন করতে হচ্ছে। আর দালালদের মাধ্যমে অর্থ লুট ও সীমাহীন হয়রানি সরকারী হাসপাতালের স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বেসরকারী হাসপাতালের চিকিৎসা খরচ ॥ বেসরকারী হাসপাতালসমূহের চিকিৎসাসেবার খরচ অনেকটা সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। প্রতিটি অপারেশনে ১০ হাজার থেকে ৫ লাখ টাকা লাগে। প্রতিদিন সিসিইউ সেবা পেতে ৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা এবং আইসিইউ সেবা পেতে লাগে ২০ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা। প্রতি সেশনে ডায়ালাইসিস করাতে খরচ হয় প্রায় ৫ হাজার টাকা। এভাবে করোনারি এনজিওগ্রামে ১৫ হাজার টাকা, সিটিস্ক্যানে ৪ থেকে ৬ হাজার টাকা, এমআরআই ৬ থেকে ১০ হাজার টাকা, ইসিজি ৩০০ টাকা, ইকোকার্ডিওগ্রাম ১ হাজার থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকা, এক্সরে ৫০০ টাকা, আল্ট্রাসনোগ্রাম ১ থেকে ৩ হাজার টাকা, কার্ডিয়াক ক্যাথ ১৫ হাজার টাকা, ইউরিন ২০০ টাকা এবং রক্তের হিমোগ্লোবিন, টোটাল কাউন্ট করাতে লাগে মাত্র ৪৫০ টাকা।

সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা অর্জনে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণের ওপর জোর দিয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডাঃ আবুল কালাম আজাদ জনকণ্ঠকে বলেন, দেশের স্বাস্থ্যসেবার অবকাঠামোর বিস্তার ঘটেছে। বেড়েছে সেবার মান। গড়ে উঠেছে দক্ষ জনবল। কিন্তু সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা অর্জন করতে হলে সবাইকে আন্তরিক হতে হবে। সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা সেøাগান হিসেবে শুনতে ভাল। কিন্তু এই জনবহুল দেশে বাস্তবায়ন করা খুব কঠিন। অর্থ ছাড়া মানসম্পন্ন সেবা দেয়া সম্ভব নয়। সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা অর্জন করতে হলে স্বাস্থ্য, অর্থ ও জনপ্রশাসনসহ আরও বেশকিছু সংখ্যক মন্ত্রণালয়কে একসঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করতে হবে বলে মনে করেন মহাপরিচালক।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ বলেন, বিভিন্ন জরিপে দেখা যায়, বস্তি, ভাসমান, চর ও হাওড়াঞ্চলের মানুষ এখনও স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছে না। দেশের ৫৫ শতাংশ মানুষ এখনও মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত। সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার ধারণায় ২০৩০ সালের মধ্যে স্বাস্থ্যসেবার ব্যয় সহনীয় পর্যায়ে ও সাধ্যের মধ্যে নিয়ে আসার কথা বলা হয়েছে। অথচ আমাদের দেশে চিকিৎসা পেতে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয় এর ৬৭ শতাংশই রোগীকে বহন করতে হচ্ছে। সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা অর্জনের জন্য মানসম্পন্ন ও দক্ষ জনবলও দরকার। দেশে পর্যাপ্তসংখ্যক চিকিৎসক থাকলেও নার্স ও টেকনিশিয়ানের ঘাটতি আছে। সুতরাং সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে আমরা অনেকটা দূরেই আছি। অধ্যাপক ড. সৈয়দ আবুল হামিদ আরও বলেন, দেশে প্রচলিত প্রাইভেট ইন্স্যুরেন্স কেম্পানিগুলোর ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবীমা খুব গ্রহণযোগ্য না হলেও গ্রুপ স্বাস্থ্যবীমা খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। বহু প্রতিষ্ঠান এই গ্রুপ হেলথ ইন্স্যুরেন্স করছে। এর বাইরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, গ্রামীণ ব্যাংকসহ আরও বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান নিজস্ব আঙ্গিকে স্বাস্থ্যবীমা চালু করেছে। অন্যদিকে কমিউনিটি পর্যায়ে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রসহ আরও কয়েকটি সংস্থা কাজ করছে। তিনি বলেন, এখন জরুরী হয়ে উঠেছে সরকারের সিদ্ধান্ত। বেসরকারী পর্যায়ের স্বাস্থ্যবীমার কার্যক্রমের সঙ্গে সরকারী কার্যক্রমের সমন্বয় ঘটিয়ে সারাদেশের মানুষের জন্য একটি কার্যকর স্বাস্থ্যবীমা পদ্ধতি চালু করা। যার মধ্য দিয়ে সরকারের সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা পরিকল্পনা বাস্তবায়নও সহজ হয়ে উঠবে।

আন্তর্জাতিক মূল্যায়ন ॥ ল্যানসেটের প্রবন্ধে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে এই উদ্যোগ প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। এর জন্য নির্দিষ্ট কোন বাজেট বরাদ্দ নেই। এ উদ্যোগে বড় বাধা স্বাস্থ্য খাতের অদক্ষ স্বাস্থ্যকর্মী। স্বাস্থ্য জনবলের (চিকিৎসক, নার্স, টেকনিশিয়ান) ৯৪ শতাংশই অদক্ষ। স্বাস্থ্যকর্মীদের গ্রামাঞ্চলে কর্মক্ষেত্রে ধরে রাখা কঠিন।

অন্যদিকে বিশ্বব্যাংকের ‘দ্য পাথ টু ইউনিভার্সাল হেলথ কাভারেজ ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, ইউএইচসি অর্জন করতে হলে বাংলাদেশ সরকারকে স্বাস্থ্য খাতের জন্য বাড়তি অর্থায়নের ব্যবস্থা করতে হবে। দক্ষ জনবলের জন্য প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট গড়ে তোলার পাশাপাশি গ্রাম ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে স্বাস্থ্যকর্মী ধরে রাখার জন্য বাস্তবসম্মত উদ্যোগ নিতে হবে।

কেন্দ্রীভূত ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির পরিবর্তন দরকার ॥ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারী স্বাস্থ্যসেবা অবকাঠামোর দক্ষ ও ফলপ্রসূ ব্যবহারের অন্যতম প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে ‘কেন্দ্রীভূত ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি’। এমন অভিযোগ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, চিকিৎসা সরঞ্জাম ক্রয়, সংগ্রহ, রক্ষণাবেক্ষণ, মেরামত এবং সংস্কার করার জন্য প্রচলিত সরকারী নীতিমালা সময়সাপেক্ষ ও জটিল হওয়ায় সেটি প্রায় স্বাস্থ্যসেবা প্রদানে অন্তরায় হয়ে উঠে। পর্যাপ্ত জনবল, আর্থিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতাসহ প্রয়োগধর্মী জাতীয় স্বাস্থ্য গবেষণা ব্যবস্থার অভাব রয়েছে। এতে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ও কর্মসূচী, সেবা প্রদান ও গরিববান্ধব নীতিমালা প্রণয়ন এবং গবেষণার মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন বিঘিœত হয়। স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের ব্যবস্থাপনা উন্নত করার উদ্দেশ্যে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবহার এখনও যথেষ্ট নয়। এক্ষেত্রে বিভিন্ন পর্যায়ের স্বাস্থ্য জনশক্তির আগ্রহ ও দক্ষতার অভাব এবং প্রয়োজনীয় অবকাঠামোর অপ্রতুলতা বেশ দৃশ্যমান। সরকারী স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় ওষুধ সরবরাহের অপর্যাপ্ততা, জনবলের অভাব, যন্ত্রপাতি ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রের স্থাপনায় রক্ষণাবেক্ষণের দুর্বলতা ও প্রশাসনের জটিলতা এবং সুসংগঠিত রেডারেল পদ্ধতি না থাকায় স্বাস্থ্য অবকাঠামোর পূর্ণ সদ্ব্যবহার করা যাচ্ছে না। দেশে স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে সৃষ্ট বর্জ্যরে ব্যবস্থাপনা, পরিবেশ, পেশাগত স্বাস্থ্য এবং নিরাপত্তার দিক দিয়ে সন্তোষজনক নয়। স্বাস্থ্যসেবার পূর্ণতা অর্জনের জন্য সরকারী এবং বেসরকারী খাতে অর্থের সংকুলান ও ব্যবস্থাপনা অপর্যাপ্ত। এতে দেশের মোট জনসংখ্যার বড় অংশ এখনও বিভিন্ন জটিল রোগের উন্নত চিকিৎসাসেবা গ্রহণ করতে পারে না। উন্নত স্বাস্থ্যসেবা এখনও অনেকটাই জেলা ও বিভাগ কেন্দ্রিক। উপজেলা পর্যায়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকসহ উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই।

সূত্রঃ জনকণ্ঠ

About Post Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *