জলবায়ু বিপর্যয়ে বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি, উচ্চ রক্তচাপ, অকাল গর্ভপাত, সিওপিডি, হিটস্ট্রোকসহ বহু রোগ

তাপমাত্রা ও আবহাওয়ার অস্বাভাবিক আচরণ ও গতি-প্রকৃতির প্রভাব দিনে দিনে জনস্বাস্থ্যের ওপর মারাত্মক হয়ে উঠছে—বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এমন সতর্কতা আগেই ছিল। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকির মুখে থাকা অন্যতম দেশ হিসেবে বাংলাদেশের প্রতিও ওই সতর্কতা বেশ জোরালোভাবেই ছিল। এত দিন মশাবাহিত ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, ম্যালেরিয়া বা পানিবাহিত কলেরা, ডায়রিয়ার মতো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সংক্রামক রোগগুলো ঘিরেই জলবায়ুর প্রভাবজনিত ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছিলেন দেশের জনস্বাস্থ্য ও রোগতত্ত্ববিদরা। এবার দেশের গবেষকদের গবেষণায় শুধু সংক্রামক রোগই নয়, অসংক্রামক রোগের ওপরও জলবায়ুর প্রভাবের তথ্য পাওয়া গেছে। বিশেষ করে দেশে অসংক্রামক রোগে মানুষের মৃত্যুঝুঁকির বড় কারণ হিসেবে চিহ্নিত উচ্চ রক্তচাপের সঙ্গে জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবের যোগসূত্র মিলেছে।

এ ছাড়া হিটস্ট্রোক, অকাল গর্ভপাত, দীর্ঘমেয়াদি শ্বাসতন্ত্রের সমস্যা, হাঁপানি, পানিশূন্যতাসহ আরো বেশ কিছু রোগ বেড়ে যাওয়ার পেছনে এখন জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবকে দায়ী করা হচ্ছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বেনজীর আহম্মেদ বলেন, জলবায়ুর প্রভাবে সমুদ্র-নদীর পানি হ্রাস বৃদ্ধি যেমন ঘটে তেমনি তাপমাত্রা প্রভাবিত হয়ে থাকে। আর বায়ুদূষণের মাত্রাও বেড়ে যায়। শহর কিংবা গ্রামের প্রতিটি মানুষই কোনো না কোনোভাবে তা প্রতিনিয়ত টের পাচ্ছে, ভোগ করছে। সাধারণভাবে বললে অতি-তাপমাত্রার প্রভাবে মানুষ শারীরিক ও মানসিকভাবে অসুস্থ বোধ করে বলেই সবাই গরমে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে বা হাঁসফাঁস করতে থাকে। এর মধ্যে সবার শরীরের সহনশীলতার মাত্রা এক না হওয়ায় তারা আরো বেশি উপসর্গে আক্রান্ত হয়। অনেকের রক্তচাপ বেড়ে যায়, ঘামে পানিশূন্যতা দেখা যায়, কেউ কেউ মাথা ঘুরিয়ে পড়ে যায়, অনেকে শ্বাসকষ্টে ভুগতে শুরু করে। এ ছাড়া বায়ুদূষণ থেকে বেশির ভাগ মানুষের শ্বাসকষ্ট দেখা যায়। অতিবর্ষণেও এমন ভিন্ন ভিন্ন কিছু উপসর্গ দিনে দিনে বেড়ে চলছে দেশে। উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততার প্রভাব তো রয়েছেই।

সম্প্রতি আন্তর্জাতিক উদরাময় রোগ গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ বা আইসিডিডিআর,বির উদ্যোগে ‘ইএসপিএ ডেল্টাস’ নামের একটি গবেষণার ফলাফলে দেখা গেছে, পানিবাহিত অসহনীয় মাত্রার লবণ থেকে মানুষের মধ্যে উচ্চ রক্তচাপের প্রকোপ বাড়ছে। এ ক্ষেত্রে পুরুষের চেয়ে নারীর ঝুঁকি ৩১ শতাংশ বেশি। বিশেষভাবে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলগুলো থেকে এমন চিত্র উঠে এসেছে। এ ছাড়া গর্ভবতী নারীদের অকাল গর্ভপাত হওয়ার পেছনে অতি-লবণাক্ততার প্রভাব থাকার উপাত্ত মিলেছে। বিশেষভাবে উপকূলীয় অঞ্চলগুলো থেকে এমন চিত্র উঠে এসেছে।

আইসিডিডিআর,বির ইএসপিএ ডেল্টাস কার্যক্রমের গবেষক ড. কামরুন নাহার বলেন, গবেষণার ফলাফল অনুসারে দেশের ৯টি উপকূলীয় জেলার ২১টি ইউনিয়নে শুধু সাগর-নদী-জলাশয়ই নয়, গভীর ও অগভীর নলকূপের পানিতেও মানুষের শরীরের জন্য সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি মাত্রার লবণাক্ততা পাওয়া গেছে। এ ক্ষেত্রে বলা হয়, প্রতিলিটার টিউবওয়েলের পানিতে দুই হাজার মিলিগ্রাম লবণাক্ততাকে মোটামুটি সহনীয় মাত্রা হিসেবে ধরা হয়। কিন্তু ওই সব এলাকায় অগভীর ও গভীর নলকূপের বেশির ভাগেই প্রতিলিটার পানিতে তিন হাজার ১৫১ থেকে ছয় হাজার ৫৮০ মিলিগ্রাম মাত্রার লবণাক্ততা পাওয়া যায়। আর ওই পানি পান করে—এমন মানুষের ওপর পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, ৩৫ বছরের ওপরের বয়সী মানুষের মধ্যে উচ্চ রক্তচাপের উচ্চ ঝুঁকি রয়েছে।

একই কার্যক্রমের আরেক গবেষক ড. এস এম মঞ্জুর আহম্মেদ হানাফি বলেন, ‘আমরা চকরিয়া এলাকায় কাজ করতে গিয়ে দেখেছি সেখানে সমুদ্রের কাছাকাছি থাকা গর্ভবতী নারীদের মধ্যে অকাল গর্ভপাতের মাত্রা বেশি। সেখানে আমরা সমুদ্র ও নলকূপের পানি পরীক্ষা করে অতিমাত্রায় লবণাক্ততার নজির পেয়েছি, যা দিনে দিনে বাড়ছে। জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব থেকেই এমনটা হচ্ছে বলে আমাদের প্রাথমিক গবেষণায় ধারণা পেয়েছি। এখন আমরা আরো বিস্তৃত কাজে হাতে দিয়েছি।’

জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. এম আশ্রাফ আলী বলেন, ‘উপকূলীয় অঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাবে পানিতে লবণাক্ততার মাত্রাও প্রভাবিত হয়। ভূস্তরের পানির মতো ভূগর্ভস্থ পানিতেও লবণের মাত্রা বেড়ে যায়। ফলে নলকূপের পানিতে অসহনীয় মাত্রার লবণ উঠে আসে।’ এই বিশেষজ্ঞ বলেন, উপকূলীয় অঞ্চলের মতো রাজধানী ঢাকা বা অন্যান্য শহর এলাকার পানিতে জলবায়ুর প্রভাবে লবণাক্ততা না থাকলেও পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়া, ভূগর্ভে পানির পরিমাণ কমে যাওয়ার পেছনে জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবের যোগসূত্র থাকে। আর সেখান থেকে সৃষ্ট পানীয় জলের সংকটজনিত জনস্বাস্থ্যের সমস্যাকে জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবের পরোক্ষ যোগসূত্র হিসেবে দেখা যায়।

ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট সূত্র জানায়, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বিশ্বব্যাপী পাঁচটি স্পর্শকাতর ঝুঁকির বিষয় চিহ্নিত হয়েছে। এগুলো হলো ঘূর্ণিঝড় বেড়ে যাওয়া, প্লাবন বেড়ে যাওয়া, খরা বেড়ে যাওয়া, লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়া এবং বরফ গলে যাওয়া। এর মধ্যে প্রথম চারটি বিষয় বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। এর সব কটি থেকেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি বয়ে আনতে পারে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে সাম্প্রতিক সময়গুলোতে তাপমাত্রা, বৃষ্টি, বন্যা কিংবা খরার বিরূপ আচরণ খুবই পরিষ্কারভাবে টের পাওয়া যায়। কোনোটিই আগের মতো সময় মানছে না। অসময়ে যেমন অতিবৃষ্টি হয় তেমনি আবার অসময়ে খরা কিংবা বন্যাও হয়। বিশেষ করে এমন পরিস্থিতিতে পানি ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস ও রাসায়নিক দূষক পদার্থ বহন করে থাকে। একইভাবে ছত্রাকের বৃদ্ধি ঘটায় ও নানা কীটপতঙ্গের বংশবৃদ্ধিতে সাহায্য করে।

ডায়রিয়া বা কলেরার প্রকোপ বৃদ্ধিতেও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাবকে দায়ী করা হয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. মাহমুদুর রহমান বলেন, ‘তাপমাত্রা অস্বাভাবিক বেশি হলে আমরা যেমন ডায়রিয়া বা কলেরার প্রকোপ বৃদ্ধির প্রবণতা দেখি, তেমনি অতিবর্ষা ও বন্যার প্রভাবেও একই পরিণতি দেখতে পাই। কারণ এমন পরিস্থিতিতে পানি দূষিত হয়ে পড়ে বেশি মাত্রায়। আর প্রধানত দূষিত পানির কারণেই ডায়রিয়া ও কলেরার প্রকোপ দেখা দেয়। তবে ডায়রিয়া-কলেরা ছাড়াও টাইফয়েড, জন্ডিস, চর্মরোগসহ আরো বেশ কিছু রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে পানিদূষণের কারণেই।’

About Post Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *