উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হয়েও জানেন না অর্ধেক মানুষ

দেশে উচ্চ রক্তচাপ আক্রান্তের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। আগে বয়স্কদের মধ্যে রক্তচাপের প্রবণতা বেশি থাকলেও কয়েক বছর ধরে তরুণরা এই নীরব ঘাতকের শিকার হচ্ছেন। আক্রান্ত হয়েও প্রায় অর্ধেক মানুষ জানেন না, উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হয়েছেন। আক্রান্তদের মধ্যে প্রতি তিনজনের একজন রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের ওষুধ সেবন করেন। একইসঙ্গে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের বাইরে রয়েছেন। অপরিকল্পিত নগরায়ণ, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস ও গড় আয়ু বৃদ্ধির কারণে উচ্চ রক্তচাপের রোগী বাড়ছে বলে মনে করেন সংশ্নিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের সাবেক ডিন অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ বলেন, উচ্চমাত্রায় লবণের ব্যবহারের কারণে প্রায় ৬০ শতাংশ রোগী এই রোগে আক্রান্ত হয়। এছাড়া ধূমপান, অ্যালকোহল সেবন, চর্বিযুক্ত খাবার গ্রহণ, হাঁটাচলা ও ব্যায়াম না করার কারণে মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হয়। উচ্চ রক্তচাপের কারণে মস্তিস্কের রক্তক্ষরণ, হার্ট অ্যাটাক, কিডনি বিকল ও চোখের রেটিনা নষ্ট হয়ে যেতে পারে। উচ্চ রক্তচাপ থেকে দূরে থাকতে নিয়মতান্ত্রিক জীবনযাপন করতে হবে। নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে, চর্বিযুক্ত খাবার কম খেতে হবে। ধূমপান ও অ্যালকোহল বর্জন করতে হবে। উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে নিয়মিত ওষুধ সেবন করতে হবে।

এ অবস্থায় আজ পালিত হচ্ছে বিশ্ব উচ্চ রক্তচাপ দিবস। এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ‘আপনার রক্তচাপ মাপুন’। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে দেড়শ’ কোটি মানুষ উচ্চ রক্তচাপে ভুগছে। এই রোগে প্রতি বছর প্রায় ৭০ লাখ মানুষ মারা যায়। দেশে উচ্চ রক্তচাপ আক্রান্ত মানুষের অবস্থা জানতে ২০১৬ এবং ২০১৭ সালে একটি গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। বাংলাদেশ, শ্রীলংকা ও পাকিস্তানের গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে নিয়ন্ত্রণহীন উচ্চ রক্তচাপ নিয়ে এ আন্তর্জাতিক গবেষণার নেতৃত্ব দেয় সিঙ্গাপুরের ডিউক-নাস মেডিকেল স্কুল। এই গবেষণায় বাংলাদেশের নেতৃত্ব দেয় আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর’বি)। দেশের মুন্সীগঞ্জ ও টাঙ্গাইল জেলার ১০ অঞ্চলের ৪০ বছর বা তার বেশি বয়সী ৪ হাজার ৪৪২ নারী ও পুরুষের রক্তচাপ পরীক্ষা করা হয়। এতে দেখা যায়, এক হাজার ১৪৮ জন উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত। অর্থাৎ মোট ২৬ শতাংশ মানুষের রক্তচাপ স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি।

এই গবেষণা দলের সদস্য আইসিডিডিআর’বির সংক্রামক রোগ বিষয়ক শাখার প্রধান আলেয়া নাহিদ জানান, জরিপের অন্তর্ভুক্ত প্রায় অর্ধেক ব্যক্তি জানেন না, তারা উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত। এ ছাড়া উচ্চ রক্তচাপ থাকা ব্যক্তিদের মধ্যে প্রতি তিনজনের মধ্যে একজন ওষুধ সেবন করেন। একইসঙ্গে প্রায় ৫৮ শতাংশ ব্যক্তির রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের বাইরে রয়েছে।

দেশে উচ্চ রক্তচাপে কতসংখ্যক মানুষ আক্রান্ত সে সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য-উপাত্ত নেই। তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি গত বছর থেকে এ-সংক্রান্ত একটি

জরিপ পরিচালনা শুরু করেছে। ওই জরিপ কাজ কিছুদিন আগে শেষ হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা) ডা. নূর মোহাম্মদ বলেন, ওই জরিপের কাজ শেষ হয়েছে। এখন যাচাই-বাছাই চলছে। চলতি মাসের শেষ দিকে এই জরিপের ফল প্রকাশ করা হয়।

জরিপ সম্পর্কে জানতে চাইলে ডা. নূর মোহাম্মদ বলেন, প্রতিটি বিভাগের একটি করে উপজেলা ও ইউনিয়নের নির্দিষ্ট সংখ্যক জনগোষ্ঠীকে এই জরিপের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সব মিলিয়ে ৯ হাজার ৮০০ জনের মতো মানুষের রক্তচাপ পরীক্ষা করা হয়। যাদের বয়সসীমা ২৫ থেকে ৭০ বছরের মধ্যে। জরিপের ফল সুনির্দিষ্টভাবে না জানলেও ২৬ থেকে ২৮ শতাংশ মানুষ উচ্চ রক্তচাপে ভুগছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. আফজালুর রহমান সমকালকে বলেন, উচ্চ রক্তচাপ নীরব ঘাতক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। বেশিরভাগ মানুষ জানতেই পারছে না যে, সে উচ্চ রক্তচাপে ভুগছে। হঠাৎ করে হৃদরোগ, স্ট্রোক কিংবা কিডনি রোগে আক্রান্ত হওয়ার পর পরীক্ষা করে জানা যায়, তিনি উচ্চ রক্তচাপে ভুগছিলেন।

ডা. আফজালুর রহমান বলেন, উচ্চ রক্তচাপ হৃদরোগ, হার্ট ফেইলিওর, মস্তিস্কে রক্তক্ষরণ, প্যারালাইসিস, কিডনি ফেইলিওর, চোখের ভেতর রক্তপাতের ঝুঁকি বাড়ায়। অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপের কারণে হৃদযন্ত্রের মাংসপেশি দুর্বল হয়ে যেতে পারে। দুর্বল হৃদযন্ত্র রক্ত পাম্প করতে পারে না, এ অবস্থাকে বলা হয় হার্ট ফেইলিওর। রক্তনালির গাত্র সংকুচিত হয়ে হার্ট অ্যাটাক বা ইনফেকশন হতে পারে। তাই এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।

উচ্চ রক্তচাপ বা হাইপারটেনশন কী:বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রক্তস্রোত রক্তনালির দেয়ালে যে চাপ সৃষ্টি করে, সেটিই রক্তচাপ। একজন সুস্থ মানুষের স্বাভাবিক অবস্থায় রক্তচাপ ১২০/৮০ ধরা হয়। ওপরেরটিকে বলা হয় সিস্টোলিক অর্থাৎ রক্তনালির দেয়ালের ওপর রক্তের চাপ এবং নিচেরটিকে বলা হয় ডায়াস্টলিক অর্থাৎ রক্তনালির দেয়ালের স্বাভাবিক চাপ। বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে রক্তচাপ কিছুটা বাড়তে থাকে। তখন এই পরিমাপ থেকে কিছুটা বেশি চাপকেও স্বাভাবিক বলে ধরা হয়। তবে ওপরের চাপ ১৪০-এর বেশি এবং নিচের চাপ ৯০-এর বেশি হলে তাকে উচ্চ রক্তচাপ বা হাইপারটেনশন বলা হয়।

জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের ডা. আব্দুল্লাহ শাহরিয়ার বলেন, রক্তনালি সরু অথবা শক্ত হলে উচ্চ রক্তচাপ দেখা যায়। বয়স বৃদ্ধি, ধূমপান রক্তনালিকে শক্ত করে। অপরদিকে চর্বি জমে রক্তনালি সরু হয়। মাথা ব্যথা, ঘাড়ে ব্যথা, চোখে কম ও ঝাপসা দেখা, মেজাজ সব সময় খিটখিটে থাকা, মনোযোগের অভাব উচ্চ রক্তচাপের লক্ষণ হিসেবে ধরা হয়।

About Post Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *