ফুটপাতের শরবত-জুস পানে তৃষ্ণা মিটলেও বাড়ছে স্বাস্থ্যহানির ঝুঁকি

বেশ ক’দিন ধরে চলছে প্রচণ্ড তাপদাহ। এই গরমে তৃষ্ণা মেটাতে অনেকেই ফুটপাতের বিভিন্ন দোকানের ঠাণ্ডা শরবত ও জুস  পান করছেন। দোকানিরাও তৃষ্ণার্ত গ্রাহকদের সামনে এগিয়ে দিচ্ছেন লেবুর শরবত, বেল, পেঁপে, আখ, মাল্টা, আঙ্গুরের ঠাণ্ডা জুস। এসব পানীয়কে চিকিৎসকরা বলছেন অস্বাস্থ্যকর ও দূষিত। তাদের মতে, এসব শরবত-জুস পানে তৃষ্ণা মিটলেও স্বাস্থ্যহানির ঝুঁকি বাড়ছে। এসব পানীয়তে টাইফয়েড, কলেরা, ও ডায়রিয়ার মতো রোগের জীবাণু রয়েছে বলেও তারা জানান। 
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় গ্রীষ্ম এলেই ভ্যানগাড়িতে করে শুরু হয় জুস কিংবা ঠাণ্ডা পানীয় বিক্রির প্রতিযোগিতা। একটি পানির ফিল্টারের মধ্যে বরফ, কয়েক শ লেবু ও ‘ড্রিংক পাউডার’ নিয়েই চলে এই পানীয় তৈরির প্রক্রিয়া। রাস্তার পাশে এসব পানীয়র মধ্যে লেবু আর ড্রিংক পাউডারে তৈরি পানীয় বেশ জনপ্রিয়। শুধু লেবুর পানি এক গ্লাস ৫ টাকা এবং এই ড্রিংক পাউডার মেশানোর লেবুর পানি প্রতি গ্লাস ১০ টাকায়  বিক্রি হচ্ছে।  

পল্টন এলাকার লেবুর শরবত ব্যবসায়ী করিম জানান, পাইকারি দরে এক বস্তা লেবু কেনেন তিনি। প্রতিদিন প্রায় ৬০০ গ্লাস পানীয়  বিক্রি হয় তার। ওয়াসার লাইনের পানি আর মাছের জন্য তৈরি বরফ সংগ্রহ করলেই হয়ে যায় সারাদিনের ব্যবসা। গরমে সাধারণ মানুষের এই ধরনের পানীয়ের চাহিদা বেশি হওয়ায় পল্টন, মতিঝিল ও এর আশ-পাশের এলাকায়  প্রায় ৬০টি গাড়ি আছে বলেও জানান তিনি।

ব্যবসায়ী করিম বলেন, গরমে মানুষ লেবুর পানি বেশি খায়। চাহিদা বেশি বলে বিক্রিও বেশি হয়। অনেকেই এখন এই ব্যবসা করেন। সামান্য পুঁজিতেই এই ব্যবসা শুরু করা যায়।

পানির বিশুদ্ধতার বিষয়ে জানতে চাইলে করিম বলেন, ‘ওয়াসার লাইনের পানি। সমস্যা নাই, সবাই খায়। আমরাও খাই।’

দিনে  প্রায় ৬০০ মানুষ কাছে এই শরবত বিক্রি হলেও এসব ভ্যান গাড়িতে গ্লাস থাকে ৩-৪টি। একজনের খাওয়া শেষ হলে সেই গ্লাস সাধারণ পানি দিয়ে  ধোয়ার পর সেই গ্লাসে আবারও পরিবেশন করা হচ্ছে আরেকজনকে। আবার লেবুর রস যেই যন্ত্র দিয়ে চিপে বের করা হচ্ছে, তাতেও ময়লা জমে থাকতে দেখা গেছে।  

করিমের সঙ্গে কথা বলতে বলতে দোকানে একজন গ্রাহক আসেন, তার নাম হৃদয়। তিনি করিমকে শরবত দিতে বললেন। লেবুর রসের সঙ্গে প্যাকেটের ‘ড্রিংক পাউডার’ মিশিয়ে বানানো শরবত পানের সময় কথা হয় এই প্রতিবেদকের সঙ্গে। হৃদয় বলেন, ‘এটা প্রতিদিনই খাই। গরমে শুধু পানি না খেয়ে একটু ভিন্ন স্বাদের পানি খাওয়ার জন্য এটি খাই। যদিও বাইরের খোলা পানীয় এভাবে খাওয়া উচিত নয়। অনেকদিন ধরেই তো খাচ্ছি। এখন পর্যন্ত কিছু হয়নি।’  

লেবুর শরবতের পাশাপাশি বেল, পেঁপে, আখ, মাল্টা, আঙ্গুরের জুসও বিক্রি হচ্ছে খোলা জায়গায়। অল্প দামেই বিক্রি হচ্ছে এসব জুস। একই ব্লেন্ডারেই বারবার বানানো হচ্ছে জুস। একটু ধুয়েই গ্লাসে ভরে পরিবেশন করা হচ্ছে সেই জুস।

শুধু পানীয় নয়, বিক্রি উন্মুক্তভাবে বিক্রি হচ্ছে মৌসুমি ফল তরমুজ ও আনারস। রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় এই সময়ে রাস্তার পাশে ভাসমান দোকানিরা আনারস ও তরমুজ কেটে সুন্দর করে প্লেটে সাজিয়ে বিক্রি করছেন। সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় অফিসপাড়া—মতিঝিল ও পল্টন এলাকায়।  

অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে যেমন বিক্রি হচ্ছে, তেমনি এসব ফল ধোয়ার জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে দূষিত পানি। কেটে রাখা ফলের ওপর উড়ে উড়ে বসছে মাছি, পড়ছে ধুলাবালিও। অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে বিক্রি হওয়া এসব খাবার খাওয়ায় ডায়রিয়াসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে নগরবাসী।

আন্তর্জাতিক উদারময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) থেকে জানানো হয়, গত কয়েকদিন ধরে ডায়রিয়ার রোগীর সংখ্যা বেশি। ২০ এপ্রিল ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগী ভর্তি ছিল ৮৭২ জন, ২১ এপ্রিল ছিল ৭৬৮, ২২ এপ্রিল ৮৮৯, ২৩ এপ্রিল ৮৬০, ২৪ এপ্রিল ৮৪৯, ২৫ এপ্রিল ৭৮৬, ২৬ এপ্রিল ৭৫২, ২৭ এপ্রিল ৭৪৮ ও ২৮ এপ্রিল ৬৯২ জন।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের কন্ট্রোল রুমের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, নারায়ণগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, গাজীপুর, কুমিল্লা, রাঙামাটি, পাবনা, বগুড়া, জয়পুরহাট, নওগাঁ ও ফেনীসহ মোট ১৯টি জেলায় ২৯-৩০ এপ্রিল পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে ১ হাজার ২৭৪ জন। দেখা যাচ্ছে—সারাদেশে ২৮ এপ্রিল ১১৩৪ জন, ২৭ এপ্রিল ১০৯৮, ২৬ এপ্রিল ১৩৭৫, ২৫ এপ্রিল ১৪২০, ২৪ এপ্রিল ১১০৫ জন ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে। তবে ডায়রিয়ায় কারও মৃত্যুর তথ্য পায়নি স্বাস্থ্য অধিদফতর।

চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সাধারণত বছরের মার্চ-এপ্রিল এবং জুন-জুলাই মাসের দিকে ডায়রিয়ার প্রকোপ বেড়ে যায়।   ফুটপাতের খোলা খাবার ও পানীয়ই এর বড় কারণ বলে মনে করছেন চিকিৎসকরা।  

জানতে চাইলে ড. সিরাজুল ইসলাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চিফ কনসালটেন্ট ডায়েটিশান সুকৃতি সামিরা বলেন, ‘গরমে পানি খাওয়া আমাদের শরীরের জন্য জরুরি। রাস্তার পাশে যে পানি পাওয়া যায় সেটা তো অস্বাস্থ্যকর। এসব পানির মাধ্যমে টাইফয়েড, কলেরা, ডায়রিয়ার জীবাণু খুব সহজেই মানুষের শরীরে প্রবেশ করতে পারে। বাচ্চাদের ক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে যে খুব সিভিয়ার ডায়রিয়া হচ্ছে।’

 এই চিকিৎসক আরও বলেন, ‘লেবুর যে পানি রাস্তার পাশে বিক্রি হয়, সেখানে দেখা যাচ্ছে পানির কন্টেইনার ঠিকমতো পরিষ্কার করা হচ্ছে না। গ্লাসগুলো ঠিকমতো ধোয়া হচ্ছে না। ফলে জীবাণু থেকেই যাচ্ছে। একই গ্লাস বারবার ব্যবহারের ফলে একজনের জীবাণু আরেকজনের মধ্যেও যাচ্ছে। হয়তো কোনও রোগাক্রান্ত ব্যক্তি খাচ্ছেন, সেই গ্লাস ভালো করে না ধুয়ে যখন আরেকজন সুস্থ মানুষ খাচ্ছেন, তখন জীবাণু খুব সহজেই সুস্থ মানুষটির শরীরে প্রবেশ করতে পারছে। ফলে দেখা যাচ্ছে, একজন সুস্থ মানুষের শরীরে সহজেই সংক্রমিত হচ্ছে।’

প্রায় একই কথা বললেন সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী রেজিস্ট্রার (মেডিসিন বিভাগ) ডা. আসাদুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘তীব্র গরমে  রাস্তার পাশের ঠাণ্ডা পানীয় দেখতে খুব চিত্তাকর্ষক হলেও তা আপনার স্বাস্থ্যের জন্য বড় রকমের ঝুঁকির কারণ হতে পারে। ধরুন, আপনি খুব ক্লান্ত হয়ে রাস্তার পাশের দোকান থেকে এক গ্লাস ঠাণ্ডা পানীয় পান করলেন। কিছুদিন পর হঠাৎ খেয়াল করলেন, আপনার চোখ কিংবা প্রস্রাব হলুদ বর্ণের হয়ে গেলো। সঙ্গে তীব্র বমি ও পেটে ব্যথা। এমনকি আপনার মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। এসব পানীয়র মাধ্যমে এক্যুইট হেপাটাইটিসের জীবাণু আপনার শরীরে প্রবেশ  করেছে। একদিন পরই দেখলেন আপনার ডায়রিয়া কিংবা রক্ত আমাশয় হচ্ছে। এসব পানীয় পানের মাধ্যমে আপনার কিডনি হঠাৎ বিকল হয়ে যেতে পারে। দীর্ঘমেয়াদে এসব পানীয় আপনার রক্তচাপ বাড়াতে পারে, এমনকি হৃদরোগের ঝুঁকিও বাড়াবে।’ এসব কারণে এ ধরনের পানীয় এড়িয়ে চলার পরামর্শ দেন তিনি

About Post Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *